অডিট রিপোর্টের পাহাড়,চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথ বন্ধ - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অডিট রিপোর্টের পাহাড়,চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথ বন্ধ


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :ব্যাংক খাতের বড় এ দুর্নীতির ঘটনা শনাক্ত করেছে ‘বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) অফিস। কিন্তু অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারণ একবছরের বেশি সময় জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ১৫শ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে কতিপয় গ্রাহক। আইন অনুযায়ী এ ধরনের অডিট হিসাবসম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে।

এদিকে এ কারণে সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপন করতে না পারায় আপত্তিসংক্রান্ত জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ও চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে অডিট আপত্তির মুখে আটকে থাকা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের নাগরিক সেবাও ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কমপক্ষে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি সরকারি অর্থ ব্যয়ের অনিয়মসংক্রান্ত অডিট রিপোর্ট পড়ে আছে স্তূপ আকারে। এ কারণে শুধু নিরপরাধ ব্যক্তিরাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন না, যারা সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে, তারাও এক রকম পার পেয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সমাজের অনেক রাঘববোয়ালও রয়েছে।জানতে চাইলে উপ-মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. শরীফুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ ২০২৫ সালের অডিট রিপোর্ট বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ না থাকায় রিপোর্টগুলো নিয়ম অনুযায়ী সংসদে উত্থাপন হয়নি। সে কারণে অডিট রিপোর্টের পরবর্তী কার্যক্রমও বন্ধ আছে।

বিধান অনুযায়ী দি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) অফিস সরকারের অর্থ ব্যয়ের ওপর অডিট করে। এরপর যেগুলো নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না সেগুলো রিপোর্ট আকারে দাখিল করা হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। আর যেগুলো ত্রিপক্ষীয় (সিএজি অফিস, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়) বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়, তা রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট আকারে আসে না। বই আকারে প্রকাশিত আর্থিক অনিয়মের রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। এরপর প্রতিটি অডিট রিপোর্ট আলোচনার জন্য পাঠানো হয় সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। ওই কমিটি প্রতিটি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে নিষ্পত্তি কিংবা নির্দেশনা প্রদান করে। সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা কিংবা সরকারের স্বার্থ আদায়ের জন্য দ্বিতীয় ধাপে সংশ্লিষ্ট দপ্তর উদ্যোগ নেয়। এ ধাপে সেটি পুনরায় তদন্ত হয়ে কেউ দায় মুক্তি বা অনাপত্তিপত্র পেলে বিষয়টি ফের সিএজি অফিস থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠাতে হয়। সূত্রমতে, এ প্রক্রিয়ায়ও অনেকে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সূত্র জানায়, অনাপত্তিপত্র পাওয়া অনেকের নথি প্রায় এক বছর যাবৎ সিএজি অফিসে পড়ে আছে। আবার অনেকে অনাপত্তিপত্র পেয়ে গেলেও তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অডিট অধিদপ্তরে নানা অজুহাতে আটকে আছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে ওই বছরের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। ফলে ওই সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে ‘সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি (পিএসি)’ সংশ্লিষ্ট অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতে স্থবিরতা নেমে আসে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। তবে অডিট রিপোর্টের শুনানি চালু রাখতে ওই সময় জাতীয় সংসদের বাইরে একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী জানান, সংবিধান জীবন্ত থাকাকালীন সংসদের বাইরে সরকারের আয়-ব্যয়ের অডিট নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। একমাত্র উপায় সংসদে উত্থাপনের পর সেটি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা। তবে সামরিক আইন থাকলে সেক্ষেত্রে সংবিধান স্থগিত হয়ে যায়। তখন এডহক কমিটি গঠন করে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। তবে জাতীয় সংসদ কার্যকর হওয়ার পর অডিট রিপোর্ট নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াই একমাত্র লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক।একই মত দিয়েছেন সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমেদ। তিনি জানান, জাতীয় সংসদের বাইরে অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনার কোনো সুযোগ নেই। সংসদে রিপোর্ট উত্থাপনের পর প্রতিটি অডিট রিপোর্ট আলোচনার জন্য পাঠানো হয় সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে। ওই কমিটি প্রতিটি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে নিষ্পত্তি করে। এখন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সভাগুলো সচল রাখা যেতে পারে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি রয়েছে- তাদের অবশ্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সামনে হাজির হয়ে জবাব দিতে হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই।

সূত্র মতে, সর্বশেষ ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয় ১ লাখ ৬ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকার অনিয়মসংক্রান্ত অডিট আপত্তির ৫৩টি রিপোর্ট। এর আগের বছরে উত্থাপন করা হয় ১৫ হাজার কোটি টাকার আপত্তি রিপোর্ট। এছাড়া ২০২০ সালে উত্থাপন করা হয় ২৫ হাজার কোটি টাকার আপত্তির রিপোর্ট, ২০১৯ সালে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালে উত্থাপন করা হয় ৩৮ হাজার ১৭১ কোটি টাকার আপত্তি। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সংসদে আর কোনো রিপোর্ট জমা পড়েনি। তবে ২০২৫ সালে ৩৯টি রিপোর্ট রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রতিবছর সরকারের মোট ব্যয়ের মাত্র ৭ শতাংশের ওপর অডিট রিপোর্ট করতে পারে। সক্ষমতা না থাকায় বাকিটা করতে পারে না। তবে উন্নত দেশগুলো সরকারের মোট খরচের ২০ শতাংশ পর্যন্ত অডিট করতে পারে।এদিকে সিএজি অফিস যে ৭ শতাংশ অডিট করছে, তাও এখন অনিষ্পত্তি অবস্থায় থাকছে। কারণ জাতীয় সংসদ সচল না থাকায় এসব আপত্তি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় এসব আপত্তি আলোচনা করে নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। ফলে সংসদের বাইরে গিয়ে সিএজি অফিস বিধিবহির্ভূতভাবে নিষ্পত্তি করার কোনো উদ্যোগও নিতে পারছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক অডিট রিপোর্ট জাতীয় সংসদে উত্থাপনের তালিকায় আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ৪৯৯ কোটি টাকার অনিয়মসংক্রান্ত অডিট রিপোর্ট। রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বন্ধ এয়ারওয়েজের নিকট থেকে বিভিন্ন ধরনের অ্যারোনটিক্যাল ও নন অ্যারোনটিক্যাল চার্জ আদায় না করার ৩৯৪ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া সমন্বিত গ্রাহক হিসাব (সিসিএ) থেকে অবৈধভাবে অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ, নিয়মবহির্ভূত স্টক ব্রোকারেজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টাকা আত্মসাতসহ একাধিক ঘটনায় ৩৫৩ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। এছাড়া ৭টি অনিয়মের ঘটনায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের আড়াইশ কোটি টাকার অনিয়ম শনাক্ত করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গুদামে সার সরবরাহ না করে টাকা আত্মসাতের বেশ কয়েকটি গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়েছে। এখানে আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ ৫৫৫ কোটি টাকা।

Top