শীতে গ্যাসের সংকট এলএনজি দিয়ে চাহিদা মেটানো হবে
নুর নবী জনী :দেশের শিল্পকারখানা থেকে বাসাবাড়ি-সব জায়গায় গ্যাস সংকট দেখা দেয়। আসছে শীতে নানা খাতে গ্যাস সরবরাহে যেন সমস্যা না হয় সেজন্য বাড়তি এলএনজি দিয়ে চাহিদা মেটানো হবে। চলতি বছর গ্যাসের সমস্যা কমানোর জন্য এলএনজি আমদানি বাড়ানো হয়েছে ১০৮টি কার্গোতে। যা গত বছরের তুলনায় ১৪টি কার্গো বেশি। আমদানি করা এসব এলএনজির বাকি সব কার্গো ডিসেম্বরেই দেশে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। শীতকাল আসছে। তীব্র গরমের পর শীতের কয়েকটা মাস গ্যাস নিয়ে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয় গ্রাহকদের। বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমলেও তখন গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটে। গ্যাস বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গ্যাসের পাইপলাইনের শেষ দিকে যেসব এলাকা সেসব এলাকার গ্রাহকরা গ্যাস কম পাবেন। তবে শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাস সঠিকভাবে সরবরাহ করতে চায় পেট্রোবাংলা ও তিতাস। শিল্পকারখানা গ্যাস পেলে আবাসিকের গ্রাহকরাও গ্যাস পাবেন বলেও আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকেই আমদানি করা এলএনজির কার্গোগুলো ধাপে ধাপে দেশে আসছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খাতের চাহিদা ও গুরুত্ব অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইন্স) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শীতের সময়ে গ্যাসের চাহিদা যোগান দেওয়া এবং সরবরাহ সামাল দিতে এলএনজি ব্যবহার করা হবে। এরই মধ্যে এলএনজির আমদানি বাড়ানো হয়েছে। আশা করছি শীতের মৌসুমে কেনো ধরণের সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, শিল্পকারাখানাগুলো গ্যাস সঠিকভাবে পেলে আবাসিকও পাবে। কারণ, উভয়ই একই নেটওয়ার্কের অংশ।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রতিশ্রুত গ্রাহকের গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে উৎপাদন ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার মতে, সব খাত ও গ্রাহক একসঙ্গে গ্যাস ব্যবহার করে না। তাই চলমান উৎপাদনেও চাহিদার বিপরীতে বড় ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। শীত এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমে এলেও সার উৎপাদনের জন্য সার কারখানাগুলোকে গ্যাস দিতে হয়। দেশে বর্তমানে মোট ছয়টি সার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে আশুগঞ্জ সার কারখানা ছাড়া বাকি পাঁচটি চলমান। এই পাঁচটি কারখানায় প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।
দেশে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৩ কার্গো, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৪ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়। জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গত মাসে এক ভার্চুয়াল আয়োজনে জানিয়েছিলেন, চলতি বছর ১০৪ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হবে। তবে পেট্রোবাংলার আরেকটি সূত্র বলছে, এলএনজির এই কার্গোর সংখ্যা বেড়ে ১০৮ হতে পারে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়। তখন প্রতি ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজি ৬ থেকে ৭ ডলারে পাওয়া যেত। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সেই এলএনজির দাম ৬২ ডলারে গিয়ে ঠেকে। বর্তমানে তা স্পট মার্কেট থেকে সাড়ে ১১ থেকে ১২ ডলার দামে কিনছে সরকার।
বৃহত্তর ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্যাস বিতরণ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি। তারা গ্যাস সরবরাহ করে বিদ্যুৎ (সরকার), বিদ্যুৎ (ব্যক্তিগত), ১টি সার কারখনা, শিল্প, সিএনজি, ক্যাপটিভ পাওয়ার, বাণিজ্যিক, আবাসিক, মিটারযুক্ত আবাসিক, জেনারেটরযুক্ত আবাসিক ও কয়েকটি ইটভাটায়।
তিতাস সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলা থেকে বর্তমানে তিতাসের জন্য বরাদ্দকৃত গ্যাস ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। শীতে সাধারণত এ বরাদ্দ কিছুটা কমে। কারণ এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসে। শীতের সময় যদি পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাসের সরবরাহ ভালো পাওয়া যায় তাহলে গ্রাহক পর্যায়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানা গেছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, পেট্রোবাংলা থেকে আমরা গ্যাস নিয়ে থাকি। তাদের গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি আছে ৬টি। সবার জন্য বরাদ্দগুলো ভাগ করা থাকে। পেট্রোবাংলা যতটুটু গ্যাস দেশীয় উৎপাদন এবং এলএনজি থেকে আমদানি করে সেখান থেকে তিতাসকে বরাদ্দ দেয়। দেশে বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে অনেক টাকা দিয়ে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট থাকে। এর মধ্য থেকেই শীতে বিদ্যুতে দিতে হবে। ঘোড়াশাল সার কারখানাকে গ্যাস দিতে হবে। শিল্প, বাণিজ্য, আবাসিক, সিএনজিতে দিতে হবে।
তিনি জানান, আমরা এখন পাচ্ছি ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সে তুলনায় অভিযোগের সংখ্যা কম। শীতের পরিকল্পনা ও বরাদ্দের বিষয়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে শিগগিরই আলোচনা হবে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে হবে আমাদের। দিনে কিছু এলাকার শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ থাকবে। সে সময়ে একই এলাকার আবাসিকে গ্যাসের চাপ কিছুটা কম থাকবে। অপরদিকে, রাতে যখন শিল্প বন্ধ থাকবে তখন আবাসিকে চাপ বাড়বে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ আরও জানান, বাসাবাড়িতে পুরাতন লাইনে সমস্যা, নেটওয়ার্কের কিছু লিমিটেশন আছে। গ্যাস পাইপের নেটওয়ার্কের শেষের দিকে যেসব এলাকা বা গ্রাহক আছেন তারা গ্যাস কম পাবেন। একই বিষয় শিল্পকারখানার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে কারণে চন্দ্রা, আশুলিয়া, মানিকগঞ্জের গ্রাহকরা প্রায়ই গ্যাস কম পান বা কখনো পান না। সেখানে লিমিটেশনটা থেকেই যায়। শীতে গ্যাস কিছুটা জমে যাওয়ার কারণেও বিতরণের গতি কমে। এটিও একটি সমস্যা।
সূত্রমতে, গ্যাস বিতরণের ক্ষেত্রে গ্যাসের পাইপ ও নেটওয়ার্কের একটি বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। দেশে ব্যবহৃত গ্যাসের পাইপলাইনের নেটওয়ার্কগুলোর নানা জায়গায় লিকেজ আছে। আন্তর্জাতিকভাবে গ্যাসের পাইপলাইনের আয়ুষ্কাল সাধারণত ৫০ বছর। কিন্তু বলা হয়ে থাকে ৩০-৪০ বছর পার হলে পাইপলাইন পরিবর্তন করা উচিত। সে হিসাবে দেশের বিদ্যমান গ্যাসের পাইপলাইনের অনেকটাই পরিবর্তন করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, পাইপলাইনগুলো পুরোনো হয়ে যাওয়া এবং লিকেজ সমস্যার কারণে সঠিক গতিতে অনেক এলাকায় গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।