আওয়ামী সরকারের সুপারিশ বাস্তবায়নে মরিয়া শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়



মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :দু’টি সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নাধীন থাকা অবস্থায় জুলাই আন্দোলনে পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের।তবে আওয়ামী সরকারের সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নে এবার মরিয়া হয়ে উঠেছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে চরম বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। মাউশি ভাগের উদ্যোগে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিক্ষা ক্যাডারের ১৯ হাজার কর্মকর্তা।এর ফলে তারা মর্যাদা হারানোর আশঙ্কা করছেন।২০২৩ সালে ডিসি সম্মেলনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর ভেঙে দুইভাগ করার সুপারিশ করে জেলা প্রশাসকরা।একইবছর প্রথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিকের বই ছাপার সুপারিশ করে আওয়ামী লীগ সরকার।অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আইন-২০১৮ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আইন সংশোধন হলে ২০২৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই ছাপানোর দায়িত্ব পাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। এর আগে ২০২৩ সালে বই ছাপানোর জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রস্তাবের সারসংক্ষেপে সম্মতি দিয়েছিল পতিত আওয়ামী সরকার। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কারণে শেষ সময়ে এসে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে সর্বসাধারণের মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা বলছেন, পাঠ্যবই মুদ্রণ একটি বিশেষায়িত ও জটিল প্রক্রিয়া। এনসিটিবি কারিকুলাম প্রণয়ন, পরিমার্জন মুদ্রণ ও বিতরণের সঙ্গে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। এ জাতীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ডিপিই’র দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এখন এই দায়িত্ব একটি অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিলে কারিকুলাম প্রণয়ন, পাঠ্যবইয়ের মান এবং সময়মতো বিতরণে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মূল কাজ হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন করা। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো বাংলা-ইংরেজি পড়তে পারে না। এসব গুরুতর সমস্যার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়েই অধিদপ্তর এখন বই ছাপানোর দায়িত্ব নিতে আগ্রহী।তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বই ছাপানোর জন্য বাজেট বরাদ্দ তাদের মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তারা তা এনসিটিবিকে পরিশোধ করে। তাই সরাসরি এ কাজ করলে অর্থ সাশ্রয় হবে। এছাড়া এনসিটিবি শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে বই সরবরাহ ও কাগজের মান ঠিক রাখতে পারছে না। এ বিষয়টি ডিপিই করলে নির্দিষ্ট সময়ে মানসম্পন্ন বই পাওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘কারিকুলাম প্রণয়ন, পাঠ্যবই মুদ্রণ, মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং নিয়ে আমাদের সক্ষমতা বেশি। যদি আমাদের কোনো সমস্যা থাকে সেটা সমাধান করা উচিত। কিন্তু সেটা না করে যদি ডিপিইকে প্রাথমিকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে বুমেরাং হতে পারে। কারণ তাদের এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।জানা যায়, ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ ২০২৩ সালে এনসিটিবি থেকে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ পৃথক করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার পাঠানো সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক। তিনি ফরিদ আহাম্মদের সময়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন।
মাউশির বিষয়ে একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে ২৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে মাউশি ভেঙে দুই ভাগ করার সুপারিশ করেন জেলা প্রশাসকরা। ডিসিদের এই প্রস্তাব নিয়ে তখন দেশজুড়ে তুমুল বিতর্ক ও শিক্ষা ক্যাডারের আপত্তির মুখে সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু আড়াই বছর পর আওয়ামী লীগের সেই বিতর্কিত এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এলক্ষ্যে গত ৩ জুলাই মাউশিকে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’ এবং ‘কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর’ নামে দু’টি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে স্বাক্ষর করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং অপসারণকৃত শিক্ষাসচিব সিদ্দিক জোবায়ের।সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ২১ হাজার ২৩২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, ৬৮৬টি সরকারি কলেজ এবং বিশাল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছে। এত বড় প্রশাসনিক কাঠামোর কারণে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কাক্সিক্ষত মাত্রায় সবার কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় আরও গতিশীলতা আনার জন্য এই কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা জরুরি।
শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে মহাপরিচালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন উচ্চপদে ক্যাডার কর্মকর্তারা কাজ করেন, যা তাদের জন্য একটি সুস্পষ্ট পেশাগত পথ তৈরি করে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। দুটি স্তরের জন্য দুটি ভিন্ন অধিদপ্তর হলে তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্রতিষ্ঠানেই মাধ্যমিকও থাকবে আবার উচ্চ মাধ্যমিকও থাকবে। তাহলে কোন অধিদপ্তর কাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে করে শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এছাড়া মাউশি অধিদপ্তরে উচ্চশিক্ষা থাকলেও তা মূলত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করে। ফলে শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি অধিদপ্তর হতে পারে না।
এ বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার মর্যাদা রক্ষা কমিটির সভাপতি এস এম কামাল আহমেদ বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তৈরির চেষ্টা করা হলে শিক্ষা ক্যাডারের পক্ষ থেকে জোরালো কর্মসূচি দেয়া হবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এই চেষ্টা প্রতিহত করা হবে।বিসিএস সাধারণ শিক্ষা অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, মাউশিকে বিভক্ত করার এই সিদ্ধান্তটি শিক্ষা ক্যাডারের ১৯ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করবে। অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলে শিক্ষাক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে।