ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ভারত ও মইন ইউ জড়িত - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ভারত ও মইন ইউ জড়িত


মোহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম:মহান জুলাই ২০২৪ বিপ্লবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল একটি ম্যাটিকুলাস প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে। সেই প্ল্যানিংয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের সঙ্গে একটি বিদেশি শক্তি জড়িত ছিল।জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ অটোমেটিক তৈরি হয়নি, পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার পেছনে ভারত সরকার এবং বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ সরাসরি জড়িত ছিল। জবানবন্দিতে আওয়ামী দুঃশাসনের পুরো চিত্র তুলে ধরেন মাহমুদুর রহমান। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ জবানবন্দি দেন তিনি। মাহমুদুর রহমান তার দেওয়া সাক্ষ্যে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, প্রণব মুখার্জি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানোর চুক্তি করেছিলেন। বিনিময়ে মইন ইউ আহমেদকে চাকরির নিশ্চয়তা, আর্থিক সুবিধা ও নিরাপদভাবে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় হয়েছিল। নির্বাচনে এই ফলাফলের পেছনে জেনারেল মইন এবং ডিজিএফআই-এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।

সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত জবানবন্দি দেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদ তার সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনী বিশেষ করে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডিজিএফআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিক মূল ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের মধ্যে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, বিচারপতি নিজামুল হক এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিশেষভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তি জুগিয়েছেন। আইনজীবীদের মধ্যে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক আইন সচিব দুলাল, প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন, সাবেক চিফ প্রসিকিউর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এবং মোশাররফ হোসেন কাজল উল্লেখযোগ্য। পুলিশবাহিনীর মধ্যে সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ এবং সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মনিরুল ইসলাম, আসাদুজ্জামান, হারুনুর রশীদ, বিপ্লব সরকার, মেহেদী হাসান, প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়ালের কাজ করেছেন।

নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ২০১৪ সালের রকিব উদ্দিন কমিশন, ২০১৮ সালে নূরুল হুদা কমিশনের মরহুম মাহাবুব তালুকদার ব্যতীত অন্যান্য কমিশনার এবং ২০২৪ সালের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সদস্যরা বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করেছেন।

প্রসঙ্গত, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় ৪৬তম সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক। এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসাবে জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার তাকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ মামলার অপর দুই আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান দেশের বাইরে পলাতক।

জবানবন্দি শেষে মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা তিনটি নির্বাচন সাবেক সেনাপ্রধানরা মেনে নিয়েছিলেন। শুধু মেনেই নেননি, তারা ফ্যাসিলিটেটও করেছেন। এমন তো নয় যে, সেনাবাহিনী নির্বাচনে অংশগ্রহণ (সহযোগিতা) করেনি। সেনাবাহিনী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তাদের নৈতিক দায় নিতে হবে। লিগ্যাল দায় তারা নেবে কি নেবে না, এটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু নৈতিক দায় তাদের অবশ্যই নিতে হবে। তারা তো তখন বলতে পারতেন, ঠিক আছে আপনি (শেখ হাসিনা) একতরফা নির্বাচন করবেন করেন, কিন্তু সেনাবাহিনী এর সঙ্গে জড়িত হবে না।

মাহমুদুর রহমান বলেন, এই আদালতে আগেও বিচার হয়েছে। কিন্তু সেটা বিচারের নামে প্রতিহিংসার প্রতিফলন ঘটেছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে বিচার হচ্ছে তাতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, এজন্যই আমি আজ সাক্ষ্য দিতে এসেছি। আমি একটি ইতিহাস রেখে যেতে চাই। ফ্যাসিস্টকবলিত বাংলাদেশ কেমন ছিল, সেটা যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে সাক্ষ্য দেওয়া আমার দায়িত্ব।

মাহমুদুর রহমান জবানবন্দিতে আরও বলেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা দরকার। কারণ, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মোরাল যদি উচ্চ থাকে, তাহলে তারা কোনো অবস্থাতেই একটি বিদেশি শক্তির ইঙ্গিতে দেশে কোনো পুতুল সরকারকে মেনে নেবে না। সুতরাং শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। এই পরিকল্পনায় শেখ পরিবারের সদস্য ও শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সাবেক সংসদ-সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস সরাসরি জড়িত ছিলেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে থেকে বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাপসসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি তৈরি করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে তাপসের জড়িত থাকার সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারে মুখোমুখি করা হয়নি। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার সেনাবাহিনীর প্রতি একধরনের ঘৃণা ছিল। শেখ হাসিনার সেনাবাহিনীবিদ্বেষ বাকশালের পতনের সময় থেকে শুরু হয়েছিল। সেই সময় সেনাবাহিনীর একাংশ, যারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের বিদ্রোহে একদলীয় বাকশাল শাসনের পতন হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের মধ্যেও সেনাবিদ্বেষ ছিল।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘বাংলাদেশ : আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইয়ের প্রসঙ্গ টেনে মাহমুদুর রহমান বলেন, এই সাংবাদিক (মাসকারেনহাস) শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান মাসকারেনহাসকে বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো একটি দানব সেনাবাহিনী সৃষ্টি করতে চান না। এটা তাদের পারিবারিক সেনাবিদ্বেষ। এ কারণে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও মোরাল সম্পূণরূপে ভেঙে যাক।

দেশে মব কালচার প্রতিষ্ঠা করে গণজাগরণ মঞ্চ : মাহমুদুর রহমান বলেন, শাহবাগে প্রতিষ্ঠিত গণজাগরণ মঞ্চে বিচারের দাবির পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। ২০১৩ সালে শাহবাগে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে নির্মূল করতে দিনের পর দিন বিক্ষোভের আয়োজন করে সরকার। শাহবাগের বিক্ষোভকারীদের নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে তৎকালীন সরকার। তাদের নির্দেশে সচিবালয় থেকে কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে ফাঁসির দাবিতে সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। এমনকি সংসদে দাঁড়িয়ে শাহবাগি উদ্যোক্তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানসিকভাবে শাহবাগে থাকতেন হাসিনা। এছাড়া ভারতীয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন ‘প্রটোকল না আটকালে তিনি নিজেও শাহবাগে দাঁড়িয়ে সংহতি প্রকাশ করতেন’। এতেই প্রমাণিত হয় যে শাহবাগের এই তথাকথিত আন্দোলনে ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল।

এই সম্পাদক আরও বলেন, শাহবাগের উদ্যোক্তাদের ইসলামবিদ্বেষী চেহারা প্রকাশিত হতে থাকলে এর প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়। গণজাগরণ মঞ্চে ফাঁসির দাবির বাইরেও যেসব গণমাধ্যম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের বিবেচনায় ভিন্নমতের ব্যক্তিদের মালিকানাধীন; সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবিও করে।

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তিনি আশা করছেন মাহমুদুর রহমানের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পর আর দুই-একজন সাক্ষ্য প্রদান করার মাধ্যমে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হবে। সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত হলে বিচারের যে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আছে, সে প্রক্রিয়ায় বিচারটি সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে।

Top