সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার ট্রাইব্যুনালেই হবে
নুর নবী জনী :আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন,মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার কেবল এই ট্রাইব্যুনালেই হবে,অন্য কোথাও নয়।তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালতে নয়, দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আদালতেও সম্ভব নয়। রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর। এর আগে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের এক প্রশ্নের জবাবেও চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম একই কথা বলেন। এদিন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর। এর মাধ্যমে এই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। সোমবার এ মামলায় প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হবে।
রোববার আশুলিয়ায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনাল-২-এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। বক্তব্য উপস্থাপনের পর ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেন, ‘ডিফেন্সের উচ্চপদে যারা আছেন, তাদের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে হবে নাকি অন্য ট্রাইব্যুনালে হবে-এরকম একটা প্রশ্ন এসেছে।’ এর জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই বিতর্ক অহেতুক। আইন সংশোধন করে তাদের (সশস্ত্র বাহিনী) যুক্ত করা হয়েছে। এ সময় আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারা তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর।
পরে ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর। তখন তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন তোলেন, তারা নানান বিষয় জানার জন্য প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু এটা জাজমেন্টের মধ্যে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কারণ, আইন এতটা স্পষ্ট যে এ আইন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন) ১৯৭৩, এটা মূলত তৈরিই করা হয়েছিল আর্মড ফোর্সের (সশস্ত্র বাহিনী) লোকদের বিচার করার জন্য। পরে কিন্তু অ্যামেন্ড (সংশোধন) করে আরও কিছু উপাদান এতে যুক্ত করা হয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, সুতরাং এই প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট আর্মড ফোর্সের লোকদের বিচার করতে পারবে কি না। এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারা উল্লেখ করে তারা ট্রাইব্যুনালকে দেখিয়েছেন যে, এ আইন মূলত আর্মড ও অক্সিলারি ফোর্সের বিচারের জন্য। সে কারণে যত বাহিনী, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় যত বাহিনী আছে, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন সেগমেন্টের কথা আলাদাভাবে এ আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ, যেটা ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি হবে, যেটা ওয়াইড স্প্রেড ও সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে সংঘটিত হবে, সেই অপরাধের দায়ে এই ডিসিপ্লিন ফোর্সের বা আর্মড ফোর্সের লোকদের বিচার কেবল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনেই হবে, অন্য কোথাও নয়। সেটা কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালতে নয়, বাংলাদেশে প্রচলিত যেসব ফৌজদারি আদালত আছে, সেখানেও এটা করা সম্ভব নয়। এ আইনটা খুবই সুস্পষ্ট।
এই বিচার হবে একটি ইতিহাস : রোববার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারপতি নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। সোমবার এ মামলায় প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ হবে।
সূচনা বক্তব্যে তাজুল ইসলাম বলেন, এই বিচার কেবল একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়। এটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি শক্ত বার্তা যে বাংলাদেশ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সে যত শক্তিশালী বা প্রভাবশালী হোক না কেন, এই বিচার হবে একটি ইতিহাস। এটি হবে সেই সব মানুষের আত্মত্যাগের সম্মাননা, যারা ন্যায়বিচারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ করবেন, বাংলাদেশ একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রাষ্ট্র।
আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলায় মোট আসামি ১৬ জন। তাদের মধ্যে ৮ জন গ্রেফতার আছেন। গ্রেফতার আট আসামি হলেন সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক ও সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। সাবেক সংসদ-সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামসহ এই মামলার আট আসামি পলাতক।
সূচনা বক্তব্যে মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশে দেখা গেছে, স্বৈরাচারই শুধু পালিয়ে যায়নি, তার ৩০০ এমপি, মন্ত্রিসভা, পুলিশবাহিনীর সদস্য, দলীয় নেতাকর্মী, এমনকি মসজিদের ইমাম ও নিজেদের শপথবদ্ধ রাজনীতিক বলে দাবি করা উচ্চ আদালতের বিচারকরাও পালিয়েছেন। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘মাননীয় ট্রাইব্যুনাল, আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, এ মামলায় নির্মোহ, নিরপেক্ষ, নির্ভুল ও দৃঢ় বিচার নিশ্চিত করুন। দোষীদের যথাযথ শাস্তি দিন, যাতে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরে আসে। কারণ, আমরা এমন একটি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ন্যায়বিচার কেবল একটি রায় নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। অপরাধী যত বড়ই হোক, কৃতকর্মের বিচার থেকে কেউ রেহাই পাবে না।’
আসামিদের বিরুদ্ধে সংগৃহীত প্রমাণ কেবল বিশ্বাসযোগ্যই নয়, বরং অকাট্য ও স্বতন্ত্র ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধ্বে বলে সূচনা বক্তব্যে উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপিত প্রমাণগুলো অস্পষ্ট তথ্যের বিচ্ছিন্ন টুকরো নয়। বরং একটি অবিচ্ছিন্ন ও সুদৃঢ় প্রমাণশৃঙ্খল। যার প্রতিটি অংশ পরবর্তী অংশকে আরও দৃঢ়তর করে। এই প্রমাণের সামগ্রিকতা হচ্ছে, চাক্ষুষ সাক্ষ্য, ডিজিটাল রেকর্ড, সরকারি যোগাযোগ ও ফরেনসিক প্রতিবেদন।