হোসাইন সাঈদীর বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন !তদন্ত হচ্ছে মিথ্যা সাক্ষ্যে বাধ্য করার অভিযোগ - Alokitobarta
আজ : মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হোসাইন সাঈদীর বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন !তদন্ত হচ্ছে মিথ্যা সাক্ষ্যে বাধ্য করার অভিযোগ


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :আওয়ামী লীগ সরকার এ মামলার বাদীসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে। তারা তখন নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর শেখানো বক্তব্য পেশ করেন।মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া প্রয়াত আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা সাক্ষ্য’ দেওয়ার অভিযোগ তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।ট্রাইব্যুনালে তাদের শেখানো বক্তব্য রেকর্ড করে এর ভিত্তিতে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পর ওই সাক্ষীরা ‘আসল সত্য’ প্রকাশে মুখ খুলতে শুরু করেন। এর মধ্যে মামলার বাদীসহ চারজন সাক্ষী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে স্বেচ্ছায় তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন। এই সাক্ষীদের মধ্যে একজন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডারও রয়েছেন। যিনি এ মামলার বাদী। এছাড়া সেসময় সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সত্য সাক্ষ্য দিতে এলে ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর আদালতের গেট থেকে অপহরণ ও গুম হওয়া ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত বিশা বালির ভাই সুখরঞ্জন বালিও শেখ হাসিনা ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। তাকে তখন চরম নির্যাতন করে অর্ধমৃত অবস্থায় ভারতের বর্ডার গার্ড বিএসএফ-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিএসএফও তাকে নির্যাতন করে। তিনি সে দিশের কারাগারে ৫ বছর বন্দি ছিলেন। পরে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি দেশে ফেরেন।

অভিযোগে শেখ হাসিনা ছাড়া আরও রয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, পিরোজপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ-সদস্য একেএমএ আউয়াল, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, বিচারপতি নিজামুল হক, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত, সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সাবেক সমন্বয়ক সানাউল হকসহ পিরোজপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের কয়েক নেতাকর্মী, আওয়ামীপন্থি কয়েকজন আইনজীবীসহ ৪০ জন।তদন্ত সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা সাক্ষ্য’ দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন কয়েকজন সাক্ষী। তা তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবে প্রসিকিউশন।

প্রসিকিউশন সূত্রে জানা যায়, বাদীসহ সাক্ষীদের দেওয়া অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য আদায়ে জড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্তত ৪০ জনকে বিচারের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে। তবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যাওয়ায় এ মামলার মরণোত্তর পুনঃবিচার হচ্ছে না। কারাবাসে থাকাকালীন ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাকে কারা হেফাজত থেকে চিকিৎসার নামে হাসপাতালে এনে মারা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম শনিবার বলেন, অভিযোগগুলো তদন্ত হবে। আইনি বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। তদন্তে শেখ হাসিনাসহ যার যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাদের সবার নামে প্রতিবেদন দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা। পরবর্তী সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আমরা ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ দাখিল করব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন কোনো অভিযোগ তদন্ত সংস্থায় পাঠানো হয়, তখন সেটি রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা সংক্রান্ত যত অভিযোগ এসেছে, সবই তদন্ত সংস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের কতটুকু তদন্ত হয়েছে, এখনই বলা যাচ্ছে না।অপর এক প্রশ্নে মিজানুল ইসলাম বলেন, কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী অভিযোগ করেছেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। কারা এটি করেছেন, কীভাবে করেছেন-তদন্তে প্রমাণসাপেক্ষে উপযুক্ত আইনে তাদের বিচার হবে।

এক যুগের বেশি সময় আগে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। যাদের সাক্ষ্যে সাঈদীর সাজা হয়, তাদের মধ্যে অন্তত চারজন বিবেকের তাড়নায় মৃত্যুর আগে সত্য প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৩ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখায় ‘মিথ্যা সাক্ষ্য’ দিতে বাধ্য করার লিখিত অভিযোগ করেন তারা। তারা হলেন-আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মো. মাহবুবুল আলম হাওলাদার, ৭ নম্বর সাক্ষী আলতাফ হাওলাদার, ৬ নম্বর সাক্ষী মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার এবং মামলার আরেক সাক্ষী মধুসূধন ঘরামির নাতি সুমন্ত মিস্ত্রি। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দাখিল করেন। পরে তারা গণমাধ্যমের কাছেও তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

একজন আলেমের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে আমাদের বাধ্য করা হয় : সাঈদীর মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার অভিযোগ দিয়ে বলেন,এমন একজন আলেমের (আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী) বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে আমাদের বাধ্য করা হয়। অস্ত্রের ভয় দেখানো হয়। সাক্ষ্য না দিলে আমাদের মেরে ফেলবে। হুমকির মধ্যে জীবন বাঁচাতে আমরা সাক্ষ্য দিতে আসি।’ তিনি বলেন, এই বিষয়টা (সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য) আমাকে বহু যন্ত্রণা দিয়েছে। দেশবাসীকে বিষয়টি জানাতে চাই। আমাদের মনুষ্যত্বকে প্রকাশ করতে চাই।’ বিচারের সময় কেন তা প্রকাশ করলেন না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তখন বলার মতো পরিবেশ ছিল না। এখন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’ অভিযোগ জানাতে কেউ প্ররোচনা বা ভয় দেখিয়েছে কি না-এমন প্রশ্নে মাহবুবুল আলম হাওলাদার বলেন, আমাদের কেউ ভয় বা প্ররোচনা দেয়নি। নিজেদের তাড়না থেকেই সত্য প্রকাশ করতে চাই। অপর সাক্ষী মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার বলেন, আমরা আর বেশিদিন বাঁচব না। তাই এ বিষয়টি জানাতে চাই। সাঈদী সাহেব ভালো মানুষ ও ভালো আলেম ছিলেন। আমরা প্রাণভয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। সাক্ষী মধুসূধন ঘরামির নাতি সুমন্ত হাওলাদার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সাঈদী ভালো মানুষ ছিলেন। আমার দাদু ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ তিন সাক্ষীকে আইনি সহায়তা দেওয়া আইনজীবী পারভেজ হোসাইন বলেন, সাঈদীর বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ভয় দেখানো হয়। ফলে তারা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হন। প্রসিকিউশন শাখায় ৪০ জনের নাম উল্লেখ করে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

শেখ হাসিনাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে গুমসহ ভারতে বন্দি রাখার অভিযোগ বালির : গুম, অপহরণ, নির্যাতনসহ প্রায় পাঁচ বছর ভারতে অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রাখার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে পৃথক অভিযোগ করেন পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে ২১ আগস্ট তিনি এ অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে সুখরঞ্জন বালি বলেছেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি তিনি। উলটো সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে আসায় আমাকে গুম, অপহরণ, নির্যাতন করা হয়। প্রায় পাঁচ বছর ভারতে অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রাখা হয়। সুখরঞ্জন বালি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, সে তালিকায় আছেন-আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক সংসদ-সদস্য একেএম আউয়াল, ট্রাইব্যুনালের সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সাবেক প্রধান মো. সানাউল হক, তদন্তকারী কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন প্রমুখ।

Top