কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। সমন্বিত খসড়া তৈরি হলেও সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে। মৌলিক ইস্যুগুলোতে এখন পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।সমন্বিত খসড়ার ওপর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ ১১টি দল মতামত দিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ ১৯টি দল এখনো বাকি আছে। দলগুলোর মতামত দেওয়ার সময় আজ শুক্রবার শেষ হচ্ছে। এই মতামতের ওপর রোববার থেকে বিশেষজ্ঞদের ফের আলোচনা শুরু। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা। সবকিছু মিলে চলতি আগস্ট মাসেও জুলাই সনদ চূড়ান্ত হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত দলগুলো যেখানে আছে, সেখান থেকে এক জায়গায় আসা কঠিন। এক্ষেত্রে ন্যূনতম ঐক্যে আসতে সময় লাগবে। আবার সনদ চূড়ান্ত হলেও সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা বাস্তবায়ন নিয়ে। বিশেষ করে যেসব মৌলিক বিষয়ে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনা একেবারেই কম।অর্থাৎ এগুলো কাগজেই আটকে থাকবে। আর যেগুলোতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর আইনি ভিত্তি না পেলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রটি এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে। এদিকে বৃহস্পতিবার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার।

চলতি আগস্ট মাসে ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বৃহস্পতিবার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো মত পরিবর্তন করলে দুদিনের মধ্যেই সম্ভব। তবে মত পরিবর্তন না করলে কী হবে তা বলা মুশকিল। তিনি বলেন, সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরও আলোচনা হবে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়। নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, এ প্রশ্নের জবাবে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হলো বেশির ভাগ লোকজনের সম্মতি। আর নোট অব ডিসেন্ট যেখানে রয়েছে, সেখানে বেশির ভাগ দলের সম্মতি আছে। মাত্র দু-একটি দল আপত্তি দিয়েছে। আবার আপত্তি দেওয়া দলগুলো সনদে স্বাক্ষরও করেছে। ফলে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতি তারা শ্রদ্ধা দেখাবেন বলে আমরা আশাবাদী।

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’র সমন্বিত খসড়া গত শনিবার ৩০টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়ার ওপর নিজেদের মতামত জমা দিতে আজ বেলা ৩টা পর্যন্ত সময় দিয়েছে কমিশন। ইতোমধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ১১টি দল মতামত জমা দিয়েছে।এখনো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ ১৯টি দল বাকি আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সনদের ৮৪টি সুপারিশ বাস্তবায়নের তিনটি আইনি দিক রয়েছে। প্রথমত, বেশকিছু সুপারিশ নির্বাহী আদেশ দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

দ্বিতীয়ত, কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে আইন পরিবর্তন বা নতুন আইন করতে হবে। তৃতীয়ত, মৌলিক সুপারিশ বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতেই হবে। এসব কারণে সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি। বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব নয়। ফলে পরবর্তী সরকার তা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি বলছে, নির্বাচনের আগে সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং নির্বাচন হতে হবে সনদের ভিত্তিতে।
এক্ষেত্রে সনদের একটি সুপারিশে বলা আছে, সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (আনুপাতিক ভোট) পদ্ধতিতে সদস্য নির্বাচিত হবেন। বিএনপি এক্ষেত্রে আপত্তি দিয়েছে। তবে জামায়াত এবং এনসিপি শুধু উচ্চকক্ষেই নয়, নিম্নকক্ষেও পিআর চায়। এ কারণে দুটি বিষয় নিয়ে জটিলতা রয়েছে। প্রথমত, সনদের আইনি দিক। দ্বিতীয়ত, নোট অব ডিসেন্টসহ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অবস্থান পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।

সূত্র জানায়, কমিশন আগস্টের মধ্যে সনদ চূড়ান্ত করতে চায়। এক্ষেত্রে সময় আছে ৬ কার্যদিবস। সমন্বিত খসড়ার ওপর আজকের মধ্যে দলগুলো মতামত দেবে। এই মতামতের ওপর রোববার থেকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করবে কমিশন। যাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এর মধ্যে রয়েছেন-আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন এবং ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক।বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে কমিশন। এরপর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা। ফলে আগস্টের মধ্যে সনদ চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তবে কমিশনের মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে সনদ চূড়ান্ত হতে পারে।

জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়ায় ৮৪টি সিদ্ধান্তের মধ্যে মৌলিক ১৪টি বিষয়ে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে রয়েছে-প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, তত্ত্বাধায়ক সরকারের গঠন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, আইনসভার উচ্চকক্ষে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি উল্লেখযোগ্য।সবচেয়ে বেশি আপত্তি দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও সমমনা কয়েক দল। এর মধ্যে ৯টি আপত্তি রয়েছে। ৪টিতে আপত্তি দিয়েছে সিপিবি ও বামদল, ১টিতে জামায়াতে ইসলাম এবং ২টি অন্যান্য ইসলামি দল। এর মধ্যে আবার কমন আপত্তি রয়েছে। আপত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনোটিতে পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত এবং আবার কোনোটিতে আংশিক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইস্যুগুলোতে দলগুলোর আরও কাছাকাছি আসা উচিত। ঐকমত্য না হলে এগুলোর বাস্তবায়ন অনিশ্চিত।

এ বিষয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এই সুপারিশগুলো চূড়ান্ত হয়েছে। তবে কোনো কোনো দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। তিনি বলেন, যেসব ইস্যুতে আপত্তি এসেছে, সবগুলোই মৌলিক বিষয়। এগুলো বাস্তবায়ন না হলে এত মানুষের আত্মত্যাগ অর্থহীন। তিনি আরও বলেন, আশা করি এগুলো বাস্তবায়ন হবে। কারণ যারা আপত্তি দিয়েছে, তারাও দেখেছে, অধিকাংশ দল বা মানুষ একমত। ফলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তারা সুবিচার করবে বলে আমার ধারণা। আর কোনো কারণে এটি বাস্তবায়ন না হলে তা হবে দুঃখজনক।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক : এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকায় কমিশনের কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বৈঠকে কমিশনের কর্মকাণ্ড, লক্ষ্য এবং অর্জন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপ, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এবং জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করেন। রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার কমিশনের কর্মকান্ডের প্রশংসা করেন এবং চলমান প্রচেষ্টা সফলভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কমিশন থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রসঙ্গত, জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে গত ২০ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ৬৭টি বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে ১৪টি নোট অব ডিসেন্ট পাওয়া গেছে। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া। গত শনিবার (১৬ আগস্ট) তা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। আর সনদ বাস্তবায়নের আইনিভিত্তি নিয়ে তাদের সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক হবে।এরপরই চূড়ান্ত হবে বহুকাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই মাসের মধ্যে এটি হওয়ার কথা ছিল। এরপর আগস্টের মধ্যেও না হলে তা হবে দুঃখজনক।

Top