থানা-ফাঁড়ি লুট,উদ্ধার হয়নি সাড়ে ১৩শ অস্ত্র
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: গত এক বছরে ডেভিল হান্টসহ বেশ কয়েকটি অভিযান চালিছে সরকার। বিশেষ অভিযান চলছে এখনো। কিন্তু বেহাত থেকেই যাচ্ছে লুণ্ঠন হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব অবৈধ অস্ত্রের সুবিধা পাবে প্রভাবশালীরা। এখনো উদ্ধার হয়নি পুলিশের লুণ্ঠিত এক হাজার ৩৬৩ অস্ত্র ও দুই লাখ ৫৭ হাজার ৭২০ গোলা-বারুদ। এসব অস্ত্র-গোলাবারুদের বড় একটি অংশ চলে গেছে দাগি আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি ও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। অস্ত্র উদ্ধারে কাজে আসেনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পুরস্কারের ঘোষণা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নাশকতায় অংশ নেবে সন্ত্রাসীরা। সংঘাত-সহিংসতার মাধ্যমে নষ্ট করবে নির্বাচনের পরিবেশ। তাই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশকে আরও জোরালো অভিযান চালাতে হবে।জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকলে তা নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। তাই নির্বাচনের আগেই লুণ্ঠিত সব অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে- নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কাজেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই।’
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই থানা, ফাঁড়ি, বক্সসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট-স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হয় বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, সে সময় থানা-ফাঁড়ি থেকে ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুণ্ঠিত হয়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৯০টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এখনো ১ হাজার ৩৬৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে-রাইফেল (চায়না) ১১৪টি, রাইফেল-টি ০৮ (বিডি) ১টি, এসএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৩০টি, এলএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৩টি, পিস্তল-টি ৫৪ (চায়না) ২১৩টি, পিস্তল ৪৬১টি, বোর শটগান ৪০১টি, গ্যাস গান (সিঙ্গেল শট) ১৩১টি, টিয়ারগ্যাস লাঞ্চার (সিক্স শট) ৭টি এবং সিগন্যাল পিস্তল ২টি।
একই সময়ে থানা থেকে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টি গোলাবারুদ লুট হয়। যার মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ১১২টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। এখানো ২ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০টি গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া গেলাবারুদের মধ্যে-বিভিন্ন বোরের গুলি ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪০৩টি, বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস সেল ১১ হাজার ৩৯১টি, বিভিন্ন ধরনের টিয়ারগ্যাস গ্রেনেড ২৯১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ১ হাজার ১৭২টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ৪১টি, সেভেন/মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ২২টি, ফ্ল্যাশ ব্যাং/ ৬ ব্যাং গ্রেনেড ২৮৪টি এবং হ্যান্ড হেল্ড টিয়ারগ্যাস স্প্রে (ক্যানিস্টার) ১১৬টি।
এদিকে গত ১ বছরে দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ হত্যা-খুন ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অস্ত্র প্রদর্শন বেড়েছে। যদিও এসময়ে সম্পূর্ণরূপে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। এমন অবস্থায় লুণ্ঠিত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করাই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।অপরাধ বিশ্লেষকদের দাবি, যারা অস্ত্র লুট করেছে তারা সাধারণ মানুষ নয়। এদের বেশিরভাগই সন্ত্রাসী, উগ্রপন্থি, চরমপন্থি ও কিশোর গ্যাং। অনেকের নামে রয়েছে একাধিক মামলা। এসব অস্ত্র দিয়ে তারা অপরাধমূলত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। প্রভাবশালীদের পক্ষে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে নির্বাচনে। সংঘাত-সহিংসতার মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে। অনেকে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠের নামার প্রস্তুতিও নেবে। তাই সরকারের পুরস্কারের ঘোষণায়ও তারা লুটের অস্ত্র ফেরত দেবে না।
অনেকেই মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের একার পক্ষে এসব অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব নয়। এগুলো উদ্ধারে প্রায়োরিটির ভিত্তিতে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তারা কি ধরনের অপরাধ করেছে তা বের করতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গভেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হকবলেন, আমাদের থানা থেকে যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে তার একটা অংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। এই অস্ত্রগুলো কোথায় আছে- তা পর্যাবেক্ষণের মধ্যেও নেই। অস্ত্রগুলো পর্যাবেক্ষণের মধ্যে থাকলে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। যত বেশি অস্ত্র অপরাধীদের কাছে থাকবে- নির্বাচনসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তত বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, পুরস্কারের ঘোষণা করে কিংবা সরল আহ্বানের মাধ্যমে কেউ লুটের অস্ত্র ফেরত দেবে না। কারণ লুটকারীরা সাধারণ মানুষ নয়। এই অস্ত্র দিয়ে তারা অপরাধ করছে। সামনে নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে।