আইনি ভিত্তি দেওয়ার উদ্যোগ জুলাই সনদকে - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আইনি ভিত্তি দেওয়ার উদ্যোগ জুলাই সনদকে


মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্স (মতামত) দেওয়ার চিন্তা চলছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও শিগগিরই আরেক দফা আলোচনা শুরু হবে।বহুল কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদকে সর্বোচ্চ আইনি ভিত্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে যা-ই থাকুক, জুলাই সনদ প্রাধান্য পাবে। কিছু ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি,এছাড়া সনদের প্রাথমিক খসড়া আজকেই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চলে যাবে। এই খসড়ার ওপর দলগুলো আলোচনা করবে। এর মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিরোধ মেটাতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আর সব দলের স্বাক্ষরে চূড়ান্ত হবে সনদ। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার বলেন, সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে আমরা কাজ করছি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফা বৈঠক শেষে অনেক বিষয় চূড়ান্ত হয়েছে। তবে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে-তা নিয়ে ইতোমধ্যে আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি।এই সবকিছু মিলে সমন্বিত খসড়া তৈরি হচ্ছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে এই খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে যাবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সনদ তৈরি হবে। সব মিলিয়ে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হতে কতদিন সময় লাগবে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতির ওপর। কমিশনের আরেক সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে তা হবে দুঃখজনক।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই দফা বৈঠকে ৮২টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ বিষয়গুলোর ভিত্তিতেই তৈরি হবে জুলাই সনদ। তবে কীভাবে সনদ বাস্তবায়ন হবে, সেটির আইনি ভিত্তি নিয়ে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। যেসব বিষয় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা এখনই বাস্তবায়ন চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল।আর বিএনপিও সমমনা দলগুলো চায় নির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করবে। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ঐকমত্য কমিশনে যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, পরবর্তী সংসদ তা বাস্তবায়ন করবে। বিষয়টি নিয়ে দলগুলোর অবস্থানকে রাজনৈতিক বক্তব্য বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, কোনো দলই নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে না। এদিকে বুধবার এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি প্রদান করতে হবে। তারপর এর আলোকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদের ক্ষেত্রে সরকারকে একবিন্দুও ছাড় দেবেন না তারা। তিনি বলেন, ‘গত এক বছর ছাড় দিয়েছি। জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দিয়েছি। জুলাই সনদে কোনো ছাড় হবে না। এক পার্সেন্ট ছাড়ও জুলাই সনদে দেওয়া হবে না।তবে বিষয়টি সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এক্ষেত্রে কয়েকটি মতামত উঠে এসেছে। এর মধ্যে আছে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন, জুলাই সনদকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে সুপ্রিমকোর্টের মতামত গ্রহণ (রেফারেন্স) এবং বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশেষ বিকল্প কোনো ব্যবস্থা। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

এদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি কী হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই শেষ দফার আলোচনায় বসতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও ১ মাস বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হবে।

সূত্র জানায়, জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ায় তিনটি অংশ। প্রথম অংশে আছে সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত। আর তৃতীয় অংশে থাকছে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে কিছু সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই জাতীয় সনদের খসড়ার অঙ্গীকার অংশে কিছু পরিবর্তন আনছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

নতুন সমন্বিত খসড়ায় জুলাই সনদকে বিশেষ মর্যাদা ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, জনগণের সর্বজনীন অভিপ্রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই এই সনদ প্রচলিত আইন বা আদালতের রায়ের ওপর প্রাধান্য পাবে। এজন্য একটি বিশেষ সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, জুলাই সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, সে ক্ষেত্রে সনদই প্রাধান্য পাবে। সনদের বৈধতা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অঙ্গীকার অংশের কয়েকটি বিষয়ে আইনি দিক আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। এ বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) আরও কিছু দলের আপত্তি ছিল। তারা সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে।তবে এর ব্যাখ্যায় অধ্যাপক আলী বলেন,জুলাই অনেক খসড়া আছে। এগুলো একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু সমন্বিত খসড়া কী আছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ।

জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বৃহস্পতিবার বলেন, সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে করেছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এছাড়াও এটি নিয়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। এর ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপ হবে। তিনি বলেন, সংস্কার প্রস্তাব তৈরি হলেই হবে না। এর আইনি ভিত্তি লাগবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি জরুরি।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে তা হবে দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করতে চাই, এ ব্যাপারে একটি ঐকমতে পৌঁছানো যাবে। এতগুলো মানুষ জীবন দিল, অনেকের ত্যাগ রয়েছে। এসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোও জানে।জানা গেছে-জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে ২০ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ৬৭টি বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দুই পর্বের আলোচনায় ৮২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই সনদ। ইতোমধ্যে সনদের প্রাথমিক খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সই করার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পাবে জুলাই সনদ।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্বের আলোচনায় ১৬৫টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে২০টি মৌলিকবিষয়ের মধ্যে ১১টিতে সব দলের সমর্থন এবং ৯টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিভিন্ন দল। যে সব মৌলিক প্রস্তাবে সম্মিলিতভাবে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো হলো- ১. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

২. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, ৪. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ-(ক) সুপ্রিমকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ। ৫. জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ৬. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, ৭. সংবিধান সংশোধন, ৮. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, ৯. নির্বাচন কমিশন গঠন, ১০. পুলিশ কমিশন গঠন, ১১. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব। এছাড়া বাকি ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ (ভিন্নমত) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এগুলো হলো-১. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধন, ২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, ৩. সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান। ৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি); ৫. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি), ৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি, ৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]। তবে এসব প্রস্তাবে কোন কোন দলের ভিন্নমত রয়েছে সনদে তার উল্লেখ থাকবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। এরপর ৫ মার্চ পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৫টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এই মতামতের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়।

Top