ব্যাংক খাতে এত বড় লুটপাট পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয়নি
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : নতুন আরও ১০১ জন অর্থ পাচারকারী শনাক্ত হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা করে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ও পাচারের অর্থ ফেরত আনার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। এর আগে একজন ব্যক্তি একাই কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে-এমন ১১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছিল; যাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার মামলা করেছে।মঙ্গলবার সরকারের এক বছর পূর্তিতে দেশের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতির ওপর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মালটিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, একটি ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৫ শতাংশই খেলাপি। কারণ ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও তার বন্ধুবান্ধব মিলে সব টাকা নিয়ে চলে গেছেন। পৃথিবীর কোনো দেশে ব্যাংক খাতে এতবড় লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।
আগামী চ্যালেঞ্জ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা দূর করতে পারিনি। সেখানে কর্মরত মানুষগুলো ঠিক করতে পারিনি। এ কাজটি শুরু করেছি। এটি অব্যাহত রাখা বড় চ্যালেঞ্জ আগামীতে নির্বাচিত সরকারের জন্য।দেশের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই এক বছরে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে। কিছুটা দ্বিমত থাকতে পারে আপনাদের। তবে সুশাসনের ঘাটতি, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাত খাদের কিনারায় পড়েছিল। সেখান থেকে এখন একটু ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যে সব সূচক ছিল নেগেটিভ, এখন সব পজিটিভ হয়েছে।তিনি আরও বলেন, আইএমএফের শর্ত পালনে মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপরে ছেড়ে দিয়ে আমরা ভুল করিনি। যদিও শুরুতে শঙ্কায় ছিলাম।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, জুনে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে। বর্তমান ৮ শতাংশের উপরে আছে। আর জুলাইতে ১৪ শতাংশে বিরাজ করছে।ব্যাংক খাত প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেছেন, ব্যাংকের লুটপাটের টাকা আপনার, আমার ও ঋণের টাকা। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করতে বলেছি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা দেওয়া হবে।ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য চলতি বাজেটে কত টাকা বরাদ্দ রেখেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা জানাতে অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্য বরাদ্দ সেটি পর্যাপ্ত নয়। সেখানে আইএমএফও টাকা দেবে। ব্যাংকের আমানতকারীদের কারও অর্থ খেয়ানত হবে না এটি আমি নিশ্চিত করছি। এজন্য যা প্রয়োজন তা করা হবে।
ব্যাংকগুলো একীভূত করার প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কতগুলো ব্যাংক একীভূত করা হবে সে তথ্য প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক সমন্বয় করা মানে আমাদের দেশের ভাষা হচ্ছে শেষ হয়ে গেল। যে কারণে এ তথ্য এখনই প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক করবে।
নির্বাচিত সরকার এসে ব্যাংক খাত সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে নাও পারে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি নেবেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু কিছু আলাপ হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাংক সংস্কার কার্যক্রম উলটে-পালটে দেয়, সেক্ষেত্রে আমানতকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে ওই ব্যাংক থেকে।টাকা ফেরত আনার প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ইতোমধ্যে বড় ধরনের ১১টি কেস ফাইল করা হয়েছে। পাচারকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। কোন কোন জায়গায় পাচার করেছে সেটি শনাক্ত হয়েছে। এখন এসব টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ১২টি দেশের সঙ্গে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট (এমএলএ) করতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। টাকা ফেরত আনতে আমরাও আইনজীবীর মাধ্যমে চেষ্টা করছি।
ব্রিফিংয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, রাজস্ব আদায় নিয়ে এখনো চ্যালেঞ্জ আছে। জিডিপির কর অনুপাত বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এজন্য এ খাতে দুর্র্নীতি প্রতিরোধসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের আরও তৎপর করা হচ্ছে।বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসঙ্গে বলেন, অনেককে আমরা যোদ্ধা বলি, এর মধ্যে প্রবাসীরা প্রকৃত যোদ্ধা। ব্যবসায়ীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করেছি। আগের সরকারের ক্ষমতা কাছাকাছি ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেত। এখন সেগুলো হবে না।ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের রাজস্ব আহরণ খুব আশাতীত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ঋণ না আনলে কিভাবে চলবে। এখানে করের হার বাড়ালেই আয় বেশি হবে তা নয়। কর আদায় নির্ভর করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতির ওপর। তবে ঋণ পরিশোধের সীমা ঠিক থাকে সে ব্যাপারে সতর্ক আছি। এতকিছুর পরও ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
সংস্কার প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদির ছোঁয়া কিছুটা রেখে যাব, নির্বাচিত সরকার এসে করবে। আর ফেব্রুয়ারির আগে স্বল্পমেয়াদে সংস্কারগুলো করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা চলছে। ভালো কাজগুলো যেন এগিয়ে নিয়ে যায়।অনেকে প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন। আমাদের ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ এটি খারাপ নয়। কারণ শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমরা যা করেছি হতাশাব্যঞ্জক নয়।
ব্রিফিংয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, রিটার্নে আয়-ব্যয়, সম্পদ ও দায় সম্পর্কিত ভুল বা অসত্য তথ্য দিলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং সচেতন করার উদ্দেশে বলা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে নতুন কোনো আইন তৈরি করিনি, শুধু বিদ্যমান আইন সম্পর্কে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, খেয়াল করেছি-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন দোকানগুলোতে ফরম পূরণ করে শেখানো হচ্ছে কীভাবে শূন্য রিটার্ন দেওয়া যায়। এটা কিন্তু বিপজ্জনক। সেই কথাটাই আমরা বলতে চেয়েছি। যখন আপনাদের (করদাতা) ফাইলটা অডিটে পড়বে তখন কোনো জবাব দিতে পারবেন না। কেননা, সব তথ্যই মিথ্যা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, অসত্য তথ্য দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেই বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছি। বরং করদাতাদের সুবিধার্থে অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ চলছে। এ কাজে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ হাজার লোক অনলাইনে কর দিচ্ছেন। এটা আসলে সচেতনতা তৈরি করার একটা অংশ। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো ভয়ভীতির কিছু নেই, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য করা হয়েছে।
আন্দোলনকারী এনবিআর কর্মীদের গণহারে ছাঁটাইয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে আবদুর রহমান খান বলেন, এমন কোনো সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমে নেওয়া হয়নি। যেসব কর্মকর্তা সীমা লঙ্ঘন করেছেন, শুধু তাদের বিরুদ্ধে শোকজসহ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গণহারে চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেনি এবং সরকারও চায় না তার জনবল ত্যাগ করতে। শুধু সেই সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যারা মিডিয়ার সামনে নিজ বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন-প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী।