মাদক কারবারিদের আধিপত্য কেন্দ্র করে সংঘর্ষ,আতঙ্কিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাসিন্দারা - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাদক কারবারিদের আধিপত্য কেন্দ্র করে সংঘর্ষ,আতঙ্কিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাসিন্দারা


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া:মাদক কারবারিদের আধিপত্য কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার থেকে থেমে চলছে ভয়াবহ এই সংঘর্ষ।মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে কয়েক দিন ধরেই আতঙ্কিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা।সংঘর্ষের পঞ্চম দিন সোমবার শাহ আলম (২২) নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে গলা কেটে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ। নিহত শাহ আলম জেনেভা ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মো. রুবেলের ছেলে। এ সময় আরও তিনজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা হলেন বশির বাবুর্চি (৪০), মদিনা (২০) ও ফায়জান (২৫)। সোমবার দুপুর ৩টার দিকে ক্যাম্পের ভেতরে প্রকাশ্যে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের হুমায়ুন রোড এলাকায় হেরোইন বিক্রির স্পট দখল-পালটাদখলের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট উত্তেজনা কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সন্ত্রাসী বুনিয়া সোহেল আগে থেকেই হুমায়ুন রোড এলাকায় হেরোইন বিক্রি করে। এখানে নতুন করে পিচ্চি রাজা ও মনু মিয়ার নেতৃত্বে ইমতিয়াজ হেরোইন ব্যবসা শুরু করে। এই হেরোইনের স্পট দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে বুনিয়া সোহেল গ্রুপ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন ফয়সাল (২৫) ও সেলিম (২৪)। তাদের কাছ থেকে দুটি ধারালো চাপাতি জব্দ করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।ময়নাতদন্তের জন্য শাহ আলমের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। একই ঘটনায় আহত অন্যদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এসিডি) জুয়েল রানা জানান, সোমবার দুপুরের পর জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজনকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারিদের ধরতে অভিযান চলছে। এদিকে হত্যার মুহূর্তের একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে নেটে। সেখানে দেখা গেছে, শাহ আলমের পুরো শরীর রক্তে ভেজা। গলায় জখমের চিহ্ন। ভিডিওতে নড়াচড়া করতে দেখা গেছে তাকে। ওই সময় গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে শাহ আলমকে উদ্ধার করতে দেখা গেছে দুই ব্যক্তিকে।হত্যাকাণ্ডের পর রাতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাব যৌথ অভিযান চালায় জেনেভা ক্যাম্পে। সরেজমিন দেখা গেছে, ক্যাম্প থেকে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র, হেলমেট ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ১৩ জনকে।স্থানীয়দের অভিযোগ, জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারিরা আদালত থেকে সবাই জামিনে ছাড়া পাওয়ায় নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। শীর্ষ এসব মাদক ব্যবসায়ীর সব মামলায় জামিন বাতিল চেয়েছেন বাসিন্দারা। স্থানীয়দের অভিযোগ, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বুনিয়া সোহেল ও ‘শান্তি বাহিনী’ মিলে একের পর এক নিরীহ বাসিন্দাদের ওপর হামলা করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

সূত্র বলছে, গত পাঁচ দিন ধরে মাদকের কারবার নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পের বুনিয়া সোহেল গ্রুপের সঙ্গে চুয়া সেলিম, পিচ্চি রাজা এবং পার মনু গ্রুপের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছিল। বিশেষ করে রোববার থেকে এ সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ নেয়। রোববার দিন-রাত ক্যাম্পের ভেতরে থেমে থেমে সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার দুপুরে ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের শেষ মাথায় হুমায়ুন রোড ময়লার গলিতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষকালে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।ক্যাম্প বাসিন্দাদের সূত্রে জানা যায়, জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বুনিয়া সোহেল ও বেজি নাদিম মিলে জেনেভা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী বাহিনী ‘শান্তি বাহিনী’কে ভাড়া করে। শান্তি বাহিনীর প্রধান শাহনেওয়াজ সান্নুর নেতৃত্বে পিচ্চি রাজার মাদকের স্পট দখলে নিতে প্রথমে ককটেল বিস্ফোরণ করে হামলা চালায়। গত পাঁচ দিনে অন্তত আটটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছে স্থানীয়রা। বুনিয়া সোহেলকে পিস্তল উঁচিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়তেও দেখেছে বাসিন্দারা। সূত্র বলেছে, পুরো জেনেভা ক্যাম্পের মাদকের আধিপত্য দখল করতে বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে বেজি নাদিম, পোপলা মুন্না, চুয়া সেলিম, খুল্লা সাহিদ ও দোগলা আজম যোগ দিয়েছে। মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত জেনেভা ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

সংঘর্ষের সূত্রপাত : বৃহস্পতিবার রাতে জেনেভা ক্যাম্পের পাকা ক্যাম্প এলাকায় শোহরাবের পান দোকানের সামনে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে বুনিয়া সোহেলের নেতৃত্বে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসে কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করে। এ সময় বাবুর্চি নাসির নামে একজন গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনার দুদিন পর রোববার দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জেনেভা ক্যাম্পের ৮ নম্বর সেক্টর এলাকায় তিন দফায় তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় বুনিয়া সোহেল ও তার সহযোগীরা। এতে এলাকার অনেক দোকানের ক্ষয়ক্ষতি ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আহত হন মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী।

জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা জিয়াউদ্দিন বলেন, গত শুক্রবারও মাদক ব্যবসা কেন্দ্র করে বুনিয়া সোহেল পিচ্চি রাজাকে লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। বুনিয়া সোহেল মোটরসাইকেলে এসে প্রকাশ্যে ককটেল ফাটিয়ে চলে যায়। সোমবার দুপুরেও শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল জন্ডিস গলিতে এসে ককটেল নিক্ষেপ করে। এতে এক নারী আহত হয়েছেন বলে শুনেছি। পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেনেভা ক্যাম্পে ঢোকার আগেই তারা খবর পেয়ে যায়। তারা বিভিন্ন জায়গায় সোর্স রাখে। তারাই খবর দেয়।

জেনেভা ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, শীর্ষ মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী বুনিয়া সোহেল জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের আব্দুস সালামের ছেলে। বুনিয়া সোহেল ছাড়াও পোপলা মুন্না, বেজি নাদিম, চুয়া সেলিম, খুল্লা সাহিদ ও দোগলা আজমের নামে একাধিক মাদক ও হত্যা মামলা রয়েছে।

আরেক মাদক ব্যবসায়ী পিচ্চি রাজার নামে মাদক ও হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। গত বছরের ৩১ অক্টোবর সিলেটের কোতোয়ালি এলাকা থেকে বুনিয়া সোহেলকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। এর কয়েক মাস পরই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায় শীর্ষ এই মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী। জেল থেকে বের হয়ে আবারও তার লোকজন দিয়ে মাদক ব্যবসা শুরু করে। চলতি বছরের ৪ জুন রাতে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব-২ যৌথভাবে একটি ফার্মেসি থেকে বুনিয়া সোহেলের মাদক বিক্রির কয়েক কোটি টাকা জব্দ করে।

জেনেভা ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর অভিযান: এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর রাতেই জেনেভা ক্যাম্পে মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের ধরতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। সোমবার রাত ৮টা থেকে এ অভিযান শুরু হয়ে চলে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এ বিষয়ে রাত ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সেনাক্যাম্পে ব্রিফ করেন সেনাবাহিনীর ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক লেটেন্যান্ট কর্নেল নাজিম আহমেদ। তিনি জানান, জেনেভা ক্যাম্প ৪ নম্বর সেক্টরের মাদক ব্যবসায়ী পিচ্চি রাজা, পারমনু, চুয়া সেলিম গ্রুপ এবং প্রতিপক্ষ ৭ নম্বর সেক্টরের বুনিয়া সোহেল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বুনিয়ার সোহেল গ্রুপের শাহ আলম নামে একজন নিহত হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে ১৩ জনকে আটক করে। আটকরা হলেন, জামিল মোসলেম মতি, সাইফ, শুভ, মো. মোস্তাক, শেখ হীরা, মো. আল আমিন, মো. আকাশ, মো. রাসেল, মো. ফাইয়াজ, নাসির লেজেন মাস্ত, মো. গোলাম রসুল, মো. আ. আজিজ, ও মো. আজান।

Top