লড়াই এখনো শেষ হয়নি, আমাদের লড়াই-সংগ্রাম চলবে
মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, লড়াই এখনো শেষ হয়নি, আমাদের লড়াই-সংগ্রাম চলবে, ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার পুরো মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত, দুর্নীতি-দুঃশাসনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে না ওঠা পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে, আগেরই মতোই একতাবদ্ধ হয়ে রাজপথে লড়াই করব, যুদ্ধ করব, সংগ্রাম করব। জনতার এই লড়াই-সংগ্রামে বিজয় অর্জিত হবেই ইনশাআল্লাহ।
২৬ জুলাই (শনিবার) বিকেলে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি কর্তৃক ‘৩৬ জুলাই বিপ্লবের বীর শহীদদে’র সম্মানে আয়োজিত এক স্মরণ সভায় জামায়াত আমির এসব কথা বলেন।তিনি আরো বলেন, আসলে আজকের দিনটি আমাদের নিজেদের কাছে লজ্জিত হওয়ার দিন, অনুতপ্ত হওয়ার দিন এবং অনেকগুলো না পারার কৈফিয়ত দেয়ার দিন। ব্যক্তিগত কিছু অসুবিধার কারণে আমি মনভরে সকলের কথাগুলো শুনতে পারিনি। শুনতে পারলে আমার বিবেক আরো শান্ত হতো। আমার কর্তব্য নির্ধারণীর সহায়ক হতো। যে কয়েকজনের বক্তব্য শুনলাম তারা কোনো অন্যায় আবদার করেননি, অসংগত বক্তব্য রাখেননি। তাদের কথাগুলো, দাবিগুলো অন্তরের অন্তস্থল থেকে বের হয়ে এসেছে। আপনজন-প্রিয়জনকে তারা দেশ এবং সমাজের জন্য উপহার দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এবং জাতির যে দায়িত্ব ছিল, কর্তব্য ছিল আমি অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি রাষ্ট্রের দায় রাষ্ট্র বলবে।
জামায়াত আমির বলেন, আমি একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছি যে- আমাদেরও দায় আছে, সে দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করেছি শুধু শহীদ পরিবার না, যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সকল যোদ্ধাকে সম্মান দেখাতে। কিন্তু এটাও স্বীকার করে নিচ্ছি যেভাবে দরকার ছিল, উচিত ছিল আমরা সেটা পারিনি। এ বিষয়টি আমরা আমাদের কর্মসূচি হিসেবে নিয়েছিলাম আমরা প্রত্যেকটি শহীদ পরিবারের কাছে পৌঁছাবো, তাদের জন্য দোয়া চাইব, সান্ত্বনা দিব, তাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিব এবং তাদের কাছে আমরা দোয়া চাইব। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকতে পারে, আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না।
তিনি বলেন, সরকার কিংবা কোনো দল এমন কিছু শহীদ পরিবারকে দিতে পারবে না, যেটা একজন শহীদের বিনিময় হতে পারে। যেটা দিতে পারবে সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। বলতে গেলে তার অল্প কিছু হয়েছে, অনেক কিছু হয়নি। তারা জুলাই সনদের কথা বলেছেন এটি তো বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মুক্তির সনদ। এটি তো শুধু শহীদ পরিবারের জন্য প্রয়োজন নয়। এটা ইনডিভিজ্যুয়ালি বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের প্রয়োজন। তাহলে এ সনদ কে করবে? ১৮ কোটি মানুষ মিলে করবে? কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই।জামায়াত আমির বলেন, দেশে যদি পার্লামেন্ট থাকতো, এটা পার্লামেন্টের কাছে দাবি হতো। পার্লামেন্টের অবর্তমানে এই দায় হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর। সরকার ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে সেখানে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হচ্ছে কিন্তু এই অগ্রাধিকার পড়ে আছে পেছনে। সেটা হচ্ছে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, আমরা ঐকমত্য কমিশনে বসি। যদি জুলাই যোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে, তাদের জীবন দিয়ে আমাদের পরিবর্তন এনে না দিতেন; আমরা এখানে বসতাম নাকি কেরানিগঞ্জে থাকতাম নাকি কাশিমপুরে থাকতাম। আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাই কিভাবে? আমরা তো মাসের পর মাস সেখানে ছিলাম। আজকে এখানে জুলাই যোদ্ধাদের পাশাপাশি এই দেশের গর্বিত অনেক নাগরিক যাদের বছরের পর বছর গুম করে রাখা হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের কুখ্যাত আয়নাঘরে। তারাও কেউ কেউ এখানে উপস্থিত আছেন। যারা শহীদ হয়েছেন, যাদের খুন করা হয়েছে। তাদের সকলের পরিবার তাদের ঠিকানা এখনো খুঁজে পায়নি। যারা আয়নাঘরে ছিলেন তাদের পরিবার জানতোই না তারা বেঁচে আছেন নাকি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। এমন একটি জল্লাদ সরকারের হাত থেকে যারা মুক্তি এনে আমাদের হাতে তুলে দিলো; আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি তাদের।তিনি বলেন, ইতিহাস আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। আগামী প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় হিসেবে নিবে। এজন্য আমিও শহীদ পরিবারের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি সবকিছু আপাতত দুই দিনের জন্য রাখেন। জুলাই সনদ পাশ করেন সবাই মিলে। ঐকমত্য কমিশনে আমাদের যারা প্রতিনিধি তাদের আমরা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি, এ ব্যাপারে কোনো ধরনের আমাদের পক্ষ থেকে সামান্যতম দুর্বলতা প্রদর্শন যেন না হয়। অন্যান্য দলগুলোকে আমি আহ্বান করব ক্ষমতায় কে যাবে, কে যাবে না আল্লাহ তায়ালাই ডিসাইড করবেন।
জামায়াত আমির বলেন, নির্বাচন কবে হবে, না হবে এটাও আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করবেন। আগে নিজের কর্তব্যগুলো আমরা পালন করি। শহীদ পরিবার রাষ্ট্রের কাছে বড় কিছু চায়নি, এইটুকুর স্বীকৃতি চেয়েছেন। একটু সম্মান চেয়েছে। কিন্তু এ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে কোথায় যেন লুকোচুরি চলে। এই হীনমন্যতা কেন? কেন আমরা উপলব্ধি করি না।জামায়াত আমির আরো বলেন, বর্তমান সরকার থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি মুক্ত নাগরিক তাদের কাছে রক্তের জালে বন্দী। তাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। তারা আমার সাথে মতবিনিময়ে বসেছেন, আরো হয়তো অনেকের সাথে বসেছেন। আমি তাদের বলেছি, এ অভিযাত্রায় সকল জায়গায় সবসময় আমরা লাব্বাইক; ডাকলেই আমাদেরকে হাজির পাবেন ইনশাআল্লাহ।তিনি আরো বলেন, আপনারা জানেন যে- ১৯ জুলাই একটা সমাবেশে এটেন্ড করতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তার রেশ এখনো কাটেনি। ইতোমধ্যে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। হয়তোবা দুই/চার দিনের মধ্যে আমাকে কিছু মেডিক্যাল প্রসিডিউর-এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। আপনাদের কথা দিচ্ছি। আমরা আপনাদেরই একজন। আমাদের আপনাদের পরিবার থেকে আলাদা ভাববেন না মেহেরবানী করে। আমরা আপনাদের ঘরে ঘরে গিয়ে অনুরোধ জানিয়েছি, আপনাদের সুখের দিনে আমাদের স্মরণ না করলেও চলবে। কিন্তু দুঃখের দিনে আমরা যেন পাশে দাঁড়াতে পারি; এই খবরটুকু দিয়ে, ইনফরমেশন দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ করবেন। আমরা ওয়াদাবদ্ধ। আমরা আছি, আমরা থাকবো ইনশাআল্লাহ।
জামায়াত আমির বলেন, জুলাই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের ৭০ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত সীমিত আয়ের ছিলেন। তাদের নুন আনতে পানতা ফুরাতো। কিন্তু জাতির জন্য জীবন দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেননি। এই শহীদ পরিবারের দায়িত্ব দেশবাসীকে বিশেষ করে সরকারকে নিতে হবে। এই পরিবারগুলো কারো কাছে ভিক্ষা চায় না, তারা সম্মানের সাথে বাঁচতে চায়। তাদের মর্যাদা দিতে হবে। যোগ্যতানুযায়ী শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসিত করতে হবে, চাকরি দিতে হবে। এটার নাম কোটা নয়। কোটা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে চৌদ্দ গোষ্ঠীর কপালে যা ঝুলিয়ে দেয়া হয়, ওইটার নাম কোটা। এটা তারা আমাদের কাছে চায়নি। এটা আমাদের কর্তব্য।
তিনি আফসোস করে বলেন, এক বছর হতে চলল, আজ পর্যন্ত শহীদদের প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব হলো না। আমি বিস্মিত! তবে আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে শহীদদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যেই আমরা প্রথমে ১০ খণ্ড প্রকাশ করেছি এবং পরে আরো দুই খণ্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলোর ইংরেজি ভার্সনও প্রস্তুত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ৫ বছর পরও যদি কোনো শহীদের খবর পাই, আমরা তার প্রোফাইল তুলে আনব ইনশাআল্লাহ। আমরা চাই, আমাদের শহীদরা অম্লান হয়ে থাকুক।তিনি আরো বলেন, ত্রিশ হাজারের বেশি ইনজুর্ড হয়েছে। তাদের অনেকেই হাত-পা-চোখ হারিয়ে হাসপাতালে বা নিজ বাড়িতে ঘরের বিছানায় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে। তাদের প্রোফাইলও প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছি। তাদেরও দুটি ভলিউম ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ধারণা এই ভলিউম ১০০ খণ্ডে চলে যেতে পারে। সরকার করুক বা না করুক একটা দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে আমরা এটা চালিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এই শহীদ ও আহত পরিবারগুলোকে বুকে নিয়ে আমরা গর্বের সাথে বাঁচতে চাই।
তিনি শহীদ পরিবারগুলোকে উদ্দেশ করে বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গীকার; আমরা আপনাদের পাশে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব ইনশাআল্লাহ। আমাদের ঈদ হলে আপনাদেরও ঈদ হবে, আমাদের বাচ্চাদের লেখাপড়া হলে, আপনাদের বাচ্চাদেরও লেখাপড়া হবে ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে যদি আমাদের সবকিছু উজাড় হয়ে যায়, প্রয়োজনে জাতির এই ঋণ পরিশোধের জন্য আমরা ভিক্ষা করব, তারপরও আপনাদের পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ। আমাদের জন্য দোয়া করবেন, আমরা যে ওয়াদা করি তা যেন মিথ্যায় পর্যবশিত না হয়। তা যেন সত্যে পরিণত হয়।তিনি আরো বলেন, এখানে চিফ প্রসিকিউটর আছেন; তারা মামলাগুলো হ্যান্ডল করার চেষ্টা করছেন। আমরা জানি, তারা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত জাতি দৃশ্যমান কিছু দেখতে পায়নি। আপনাদের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি আমরা সবাই মিলে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব। তবুও জাতির সামনে বিচার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করুন, যাতে আমাদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়। ফ্যাসিবাদের মূল হোতা দুর্ধর্ষ গডমাদার, গডফাদারদের বিচার যদি জাতি দৃশ্যমান দেখতে পায়, তাহলে চ্যালা-চামুণ্ডাদের বিচারের ব্যাপারেও জাতি আশ্বস্ত হবে।
জামায়াত আমির বলেন, আমাদের দাবি, আপনারা বিচার প্রক্রিয়ার গতি দ্রুত বাড়িয়ে দিন। যদি আরো বিচারক নিয়োগ করতে হয়, প্রসিকিউশন মেম্বার বাড়াতে হয়, তবে সরকারের উচিত সহযোগিতা করা। যদি তদন্তকারী সংস্থা বাড়াতে হয়, সেটাও বাড়াতে হবে। তবে আমরা কোনোভাবেই অন্যায় বিচার চাই, ন্যায্য বিচার চাই।জামায়াত আমির আরো বলেন, আমরা জানি, ন্যায্য বিচার নিশ্চিত হলেই খুনিদের-জালিমদের লজ্জার সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে ইনশাআল্লাহ। দেশের ১৮ কোটি মানুষ এই বিচার দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। আমি সোজাসাপটা কথা বলার চেষ্টা করি; আমার কথায় কেউ আহত হলে ক্ষমা করবেন।তিনি বলেন, প্রিয় শহীদ পরিবার, আপনারা যেন আমাদের হৃদয়ে থাকতে পারেন, সেই দোয়া মহান রবের কাছে করবেন। আমাদের দ্বারা সামান্যতম অবহেলা যেন না আসে তার জন্য আল্লাহ তাআলার তাওফীক চাই। দোয়া করি, প্রত্যেকটা শহীদ জান্নাতের আলা দরওয়াজা প্রাপ্ত হোন। মহান রব, আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন। যে বোন বিধবা হয়েছেন, যে সন্তান এতিম হয়েছেন, যে বাবা মা সন্তান হারিয়েছেন, যে ভাইবোন ভাইবোনকে হারিয়েছেন তাদের আল্লাহ পর্বত সমান ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করুন। এই পরিবারগুলোকে দেখে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে আগামীর মুক্তির লড়াই-সংগ্রামে সেনানি ও সেনাপতি তৈরি হোক আল্লাহর দরবারে সেই তাওফীক কামনা করি।