শেখ হাসিনা ওদের গুলি করো’ নির্দেশ দেন - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনা ওদের গুলি করো’ নির্দেশ দেন


মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের দমনে ‘মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার’ এবং ‘যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই গুলি করার’ একটি খোলা আদেশ জারি করেছিলেন। বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার গোপন ফোনকল রেকর্ড বিশ্লেষণ করে এমনটাই জানিয়েছে কাতারভিত্তিক আলজাজিরা।

শুট দেম’ : ‘শেখ হাসিনা অর্ডারড ফায়ারিং অন বাংলাদেশ প্রটেস্টার ইন ২০২৪’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলজাজিরা ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) এআই কারসাজি হয়েছে কি না, যাচাইয়ের জন্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে রেকর্ডিংগুলো বিশ্লেষণ করেছে এবং ভয়েস ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে কলকারীদের শনাক্ত করা করেছে।

আলজাজিরার দাবি, তাদের হাতে এসেছে গোপনে রেকর্ড করা একাধিক ফোনালাপ, যেখানে শেখ হাসিনা নিজেই ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর ‘ওপেন অর্ডার’ দেওয়ার কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর ঘটনাও উঠে এসেছে রেকর্ডিংয়ে। প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের ওই আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলের ভেতরের আলোচনা, সিদ্ধান্ত ও দমননীতির বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

১৮ জুলাই জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (এনটিএমসি) রেকর্ড করা একটি কলে হাসিনা এক সহযোগীকে বলেছিলেন, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার নির্দেশ ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। আমি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত নির্দেশ জারি করেছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে সেখানেই গুলি করবে।’ তিনি বলেন, ‘এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি এখন পর্যন্ত তাদের থামিয়েছি…আমি ছাত্রদের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলাম।’

পরে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র এবং হাসিনার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনালাপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ব্যবহারের বিষয়ে কথা বলেন। তাকে বলতে শোনা যায়, ‘যেখানেই তারা কোনো সমাবেশ দেখতে পায়, তা উপর থেকে- এখন এটি উপর থেকে করা হচ্ছে-এটি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গায় শুরু হয়েছে। এটি শুরু হয়েছে। কিছু (বিক্ষোভকারী) সরে গেছে।’

সেই সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর আকাশ থেকে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ঢাকার পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‘দুর্ঘটনা ও জরুরি বিভাগের’ চিকিৎসক শাবির শরীফ আই-ইউনিটকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, অস্বাভাবিক গুলিবিদ্ধ আহত ছাত্র-বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা এগিয়ে এসেছেন।

শাবির শরীফ বলেন, ‘গুলি কাঁধে বা বুকে প্রবেশ করেছিল এবং সবগুলোই শরীরের ভেতরে রয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমরা এই ধরনের রোগীদের বেশি পেয়েছিলাম।’ ‘যখন আমরা এক্স-রে দেখেছিলাম, তখন আমরা অবাক হয়েছিলাম। কারণ, সেখানে বিশাল গুলি ছিল।’ আলজাজিরা অবশ্য কোন ধরনের গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা যাচাই করতে পারেনি।

হাসিনার নজরদারি নেটওয়ার্ক ‘এনটিএমসি’ এসব কথোপকথন রেকর্ড করেছে। এনটিএমসির বিরুদ্ধে এর আগে কেবল বিরোধী দলীয় ব্যক্তিত্বদের ওপরই নয়, এমনকি হাসিনার রাজনৈতিক মিত্রদের ওপরও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানতেন যে, তার বক্তব্য রেকর্ড করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে, অন্য পক্ষ বলেছেন…‘টেলিফোনে এই বিষয়ে আলোচনা করা উচিত নয়’। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছ থেকে উত্তর ছিল, ‘হ্যাঁ, আমি জানি, আমি জানি এটি রেকর্ড করা হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।’ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি অন্যদের জন্য অনেক গভীর গর্ত করেছিলেন। এখন তিনি নিজেই সেই গর্তে পড়ে গেছেন।’

১৬ জুলাই রংপুরের উত্তরাঞ্চলীয় শহরে পুলিশ বিক্ষোভকারী ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করে। জুলাইয়ের আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার মৃত্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল, যা জাতীয়ভাবে প্রতিবাদের জন্ম দেয় এবং বিক্ষোভকে তীব্র করে তোলে। হাসিনার মিত্র এবং উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একটি গোপন ফোন রেকর্ডিংয়ে আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে শোনা গেছে। ফোনালাপের সময় সালমান পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, রিপোর্টের কী অবস্থা।

সালমান রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কথা (যারা সাঈদের ময়নাতদন্ত করছিল) উল্লেখ করে জিজ্ঞাসা করেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেতে এত সময় লাগছে কেন? কে লুকোচুরি খেলছে? রংপুর মেডিকেল?’

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম আলজাজিরাকে বলেন, ‘একাধিক গুলির আঘাতের’ কথা বাদ দেওয়ার জন্য পুলিশ তাকে সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাঁচবার পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে।তিনি বলেন, ‘তারা একটি প্রতিবেদন লেখাতে চেয়েছিল যে, আবু সাঈদ ভাই পাথর ছোড়ার আঘাতের কারণে মারা গেছেন। (অথচ) তিনি পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন।’

সাঈদের মৃত্যুর ১২ দিন পর হাসিনার সঙ্গে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের জন্য তার পরিবারকে বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়েছিল। সেখানে ৪০টি পরিবার জড়ো হয়েছিল। তাদের সবারই আত্মীয়স্বজন বিক্ষোভে নিহত হয়েছিল।

সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা আমাদের গণভবনে আসতে বাধ্য করেছিল; অন্যথায় তারা হয়তো অন্যভাবে আমাদের নির্যাতন করত।’

ক্যামেরায় ঘটনাটি রেকর্ড করার সঙ্গে সঙ্গে হাসিনা প্রতিটি পরিবারকে টাকা তুলে দেন। তিনি সাঈদের বোন সুমি খাতুনকে বলেন, ‘আমরা তোমার পরিবারকে ন্যায়বিচার প্রদান করব।’ সুমি প্রধানমন্ত্রীকে উত্তর দেন, ‘ভিডিওতে দেখানো হয়েছে যে পুলিশ তাকে গুলি করেছে। এখানে তদন্ত করার কী আছে? এখানে আসাটা ভুল হয়েছে।’

আলজাজিরাকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, হাসিনা কখনো ‘মারাত্মক অস্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেননি এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে অনুমোদন দেননি। তিনি বলেন, আবু সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে সরকারের তদন্তের উদ্যোগের তথ্য সঠিক।

Top