দূরে থাকি কিংবা কাছে দু’আর সম্পর্ক বহাল থাকুক



আলোকিত বার্তা :জীবন যেন এক বহতা নদী। অবিরাম তার ছুটে চলা। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, একটানা তার প্রবাহ। প্রখর রোদ আর ঘন আঁধার জীবনের এই প্রবাহে কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। সুখ সচ্ছলতা আর দুঃখ-দুর্দশা কখনো তার গতিকে থামিয়ে দিতে পারে না। সদা সচল, চির বহমান আমাদের জীবন-নদী। সাময়িক জোয়ার-ভাটা আর মেঘ-তুফানে একটু যা সুখ-দুঃখের আয়োজন; এর মধ্য দিয়েই ছুটে চলে জীবন।
শৈশব, কৈশোর, যৌবন-একের পর এক ধাপগুলো পেরিয়ে জীবন ছুটে চলে অনিবার্য বার্ধক্যের দিকে। যোগ্যতা, দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার দিনগুলো পার করে যেতে থাকে নিতান্ত অসহায়ত্বের দিকে। ভোগ বিলাসিতা ও রঙ সজ্জার যাবতীয় আয়োজন শেষ করে এগিয়ে যায় অনিশ্চিত সমাপ্তির দিকে। একটু ভাবলেই বুঝে আসে, কেমন অলঙ্ঘনীয় বিধান এসব!
জীবনের এই স্রোত-প্রবাহে আমরা কতকিছু অতিক্রম করি, কতকিছু পরিবর্তন করি। বদলাতে থাকি একের পর এক কর্ম ও স্বপ্নের অঙ্গন। এসবের সাথে বদলায় আমাদের অনুভব-অনুভূতি ও প্রকৃতি পরিবেশ। বদলায় সাথী সঙ্গী ও ঘনিষ্ঠ-অঘনিষ্ঠ বহু সহকর্মী। যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের একত্র সাহচর্যে জমে থাকে অসংখ্য স্মৃতি ও অগণিত প্রিয় মুহূর্ত।
একসাথে থাকা এবং একত্রে কাজ করার সূত্রে আমরা প্রায়ই একে-অপর থেকে উপকৃত হই। একে-অপরের মাধ্যমে লাভ করি বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা। বিপদাপদে, শোক-সংকটে এবং দুঃখ-দুশ্চিন্তায় পাই সাহস, সান্ত¡না ও সমবেদনা। এরপর যখন অন্যত্র চলে যাই, চাইলেও আর তাদের জন্য কিছু করতে পারি না। পারি না তাদের প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা জানাতে। এমনকি চাইলেও আর হয়ে ওঠে না তাদের কাছে যাওয়া, দেখা করা, কথা বলা। অথচ একসময় প্রতিদিনই দেখা হত, কথা হত। হত নানান বিষয়ে কত পরামর্শ, বিভিন্ন বিষয়ে কত অভিজ্ঞতা বিনিময়। সময়ের পরিবর্তনে সবকিছুর মাঝেই এসে যায় বহু পরিবর্তন!জীবনের ছোট থেকে ছোট এবং বড় থেকে বড় কোনো বিষয়ে কারো অনুগ্রহ পেলে তার জন্যও কিছু করা উচিত। অন্তত কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত। নিঃসন্দেহে এই প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতার ফায়দা বেহিসাব। কিন্তু সুযোগের অভাবে কিংবা একান্তই অবহেলায় সেটা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না।
হাদিস শরীফে এসেছে, রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, কেউ তোমাদের জন্যে ভালো কিছু করলে তার জন্যও অনুরূপ কিছু কর। যদি তা না পারো (অর্থাৎ তার জন্য কিছু করার সুযোগ বা সামর্থ্য না থাকে), তাহলে তার জন্য এই পরিমাণ দুআ করো, যাতে মনে হয়- যথাযথ প্রতিদান তুমি তাকে দিয়েছ। (সুনানে আবু দাউদ-১৬৭২ ২৫৬৭)
এই হাদিসে অনুগ্রহের প্রতিদান দিতে যেমন উৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিদানের সুন্দর ও সহজ একটি পদ্ধতি। প্রথমে বলা হয়েছেÑ ‘তার জন্যও অনুরূপ কিছু করো’। এরপর বলা হয়েছে, এমন কিছু করার সুযোগ বা সামর্থ্য না থাকলে তার জন্য দুআ করো এবং এই পরিমাণ দুআ করো, যেন মনে হয় তুমি যথাযথ প্রতিদান তাকে দিয়েছ। নবী কারীম (সা.)-এর এই বক্তব্য অবলম্বন করে আমরা আমাদের সব হিতাকাক্সক্ষীর জন্য ছোট্ট করে হলেও কিছু করতে পারি। অন্তত তাদের অনুগ্রহ ও সহযোগিতার জন্য পারি কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং পারি মন ভরে কল্যাণের দুআ করতে। এই কৃতজ্ঞতা ও দুআ তার জন্য যেমন উপকারী, আমার জন্যও।
রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, কোনো মুসলিম অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অগোচরে (কিংবা তার অনুপস্থিতিতে) দুআ করলে, সেই দুআ কবুল হয়। সে যখন তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দুআ করে, তখন তার খুব নিকটে নিযুক্ত একজন ফেরেশতা বলেন, ‘আমীন’ (অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমার এই দুআ কবুল করুন) এবং তোমাকেও এমনটি (এই কল্যাণ) দান করুন। (সহিহ মুসলিম-২৭৩৩)
নবী কারীম (সা.)-র এই হাদিস আমাদের চিন্তার আরেকটি দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। অন্যের প্রতি কল্যাণচিন্তা ও হিতকামনাবোধ জাগিয়ে তোলে। ‘তার অগোচরে’ অর্থাৎ লৌকিকতামুক্ত কল্যাণকামিতাকে উৎসাহিত করে। পাশাপাশি সেই কামনা ও প্রার্থনার গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও ফায়দার কথা স্পষ্ট করে দেয়।