২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল ডামি ও প্রহসনের
মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত। রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা তাকে গ্রেফতার করে বৃহস্পতিবার আদালতে তোলে। রিমান্ড শুনানিতে হাবিবুল আউয়াল আদালতকে বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের নির্বাচন ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ছিল না। তখন বিচারক বলেন, আপনি পদত্যাগ করেননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। কিছু মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী ১ হাজার বছরেও এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে তিনি জানান। বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিন দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনা হয়। এ সময় তাকে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। পরে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে তাকে আদালতে তোলা হয়। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে বিচারক এজলাসে উঠেন। এরপর শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার তার ১০ দিনের রিমান্ড চান। রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি আসামির বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ করেন। নির্বাচনের বরাদ্দ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
সংবিধানবহির্ভূত বক্তব্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছেন। আমরা তার সর্বোচ্চ রিমান্ড প্রার্থনা করছি। ৩০ মিনিট ধরে শুনানি শেষে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন। হাবিবুল আউয়ালের পক্ষের আইনজীবী এমিল হাসান রোমেল রিমান্ড আবেদন বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। তিনি বলেন, উনার (সাবেক সিইসি) বয়স ৭০ বছরের বেশি। তিনি অসুস্থ, বিভিন্ন রোগে জর্জরিত। আমি শুধু এটাই বলতে চাই, আমরা ফ্যাসিস্ট দমাতে গিয়ে যেন আবার ফ্যাসিস্ট না হয়ে যাই। এর আগে বুধবার রাজধানীর মগবাজার থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
শুনানির সময় আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ২৪ সালের নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের নির্বাচন ছিল। কিন্তু এখানে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার ছিল না। তখন বিচারক বলেন, আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই অবস্থায় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধুও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল পদত্যাগের কথা, আমি বলেছি তুমি যদি আগে বলতে এমন ভয়ংকর নির্বাচন হবে তাহলে আমি দায়িত্বই নিতাম না।
এ সময় বিচারক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনি ইনকোয়ারি কমিটি হয়। যেখানে যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি? এ বিষয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, এটা আমার জানা নেই, পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করে হয়তো ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।
এরপর বিচারক আবারও বলেন, যে ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়েছিল নির্বাচনের সময় কোথাও কি তারা সরেজমিন গিয়েছিলেন? তখন আউয়াল বলেন, একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৪-৫টা সংসদীয় আসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে সহযোগিতা করতে আরও ৪-৫ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার থাকেন। একটা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ২ ভাগ দায়িত্ব কমিশনের বাকি ৯৮ ভাগ মাঠপর্যায়ে কাজ করা অফিসারদের।
এ সময় আউয়াল ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানে আমলের সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের ৩ মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত ১৯৭৩-এর নির্বাচনে আ.লীগ ২৯৩টি আসন পায়। সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতার লোভ এমন যে-শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। ৯৬ সালে আ.লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে। পরে তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সংবিধান সংশোধন করে।
এ সময় পাবলিক প্রসিকিউটর উত্তেজিত হয়ে আদালতকে বলেন, উনি যেহেতু এতকিছু বলেছেন তাহলে আমাদেরও বলার আছে। তখন পিপি বলেন, তিনি অন্যের দোষ দেখিয়ে নিজেকে জাস্টিফাই করছেন। কে কি করেছে সেগুলো বাদ দিয়ে আপনি কি করেছেন তা দেখেন। আপনার এসব বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। এ সময় আউয়াল বলেন, জাস্টিফাই না করতে দিলে রিভলভার দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন। এ সময় উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুরু করলে এজলাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন বিচারক তাদের শান্ত করেন।
পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব তুলে ধরে আউয়াল বলেন, কিছু মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী ১ হাজার বছরেও এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে যে কটি নির্বাচন হয়েছে সেগুলো সুষ্ঠু হয়েছে। বর্তমান কমিশন (নির্বাচন কমিশন) সুষ্ঠু ভোট করতে পারবে কারণ ড. ইউনূস কোনো দলের সরকারপ্রধান নয়।
এর আগে মামলার শুনানিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, আসামি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করার কথা ছিল কিন্তু তিনি তা করেননি। একটা রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করার জন্য ডামি নির্বাচন আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগকে জেতানোর জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা কাটছাঁট করেছেন। এছাড়াও নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ পার্সেন্ট ভোট পড়েছে। এর ১ ঘণ্টা পরে এসে বলেন ৪০ পার্সেন্ট ভোট পড়েছে। তিনি সাংবিধানিক দায়িত্বে থেকে জনগণের অধিকার হরণ করেছেন। তার ১০ দিন রিমান্ড মঞ্জুরের আবেদন জানাচ্ছি। এরপর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী শুনানিতে বলেন, এই আসামি ২০২২ থেকে ২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলে ২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ দেশে কলঙ্কজনক নির্বাচন হয়। সেই ডামি নির্বাচনে আ.লীগ ও দু-একটি দল ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। সেটা ছিল ডামি নির্বাচন, একতরফা, লোক দেখানো ও প্রহসনের নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিতে পারেননি। তখন তিনি বলেছেন, কেউ নির্বাচনে না এলে আমি কি বসে থাকব? আমি আমার কাজ করে যাব। তিনি ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান। অন্যায় করেছেন বলেই তিনি গা ঢাকা দেন। এরপর তাকে মগবাজার থেকে আটক করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, সারা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। এতবড় মিথ্যা বলে তিনি কিভাবে মানুষের সামনে, তার ফ্যামিলির সামনে মুখ দেখান। ওইদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। তার ১ ঘণ্টা পর এসে বলেন ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। অথচ আমরা দেখেছি কেন্দ্রগুলোতে কোনো মানুষ ছিল না। কুকুর-বিড়াল কেন্দ্রে শুয়ে আছে। ওই ১ ঘণ্টা তিনি কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে বলেন তিনি ১ ঘণ্টা নিদ্রায় ছিলেন। কতটা হাস্যকর কথাবার্তা।
২২ জুন আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনকে আসামি করে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান। এর মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনের সিইসি একেএম নূরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের পাশাপাশি তাদের সময়ের নির্বাচন কমিশনারদের আসামি করা হয়। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, একেএম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। রোববার আরেক সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে নূরুল হুদাকে ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন আদালত।
এছাড়াও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার এসআই শামসুজ্জোহা সরকার বুধবার মামলায় দণ্ডবিধির ১২৪ (ক)/৪২০/৪০৬ ধারায় অভিযোগ যুক্ত করার আবেদন করেন। পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মিনহাজুর রহমান শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করেন। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যুক্ত হয়েছে এ মামলায়।