থমথমে সচিবালয়,ক্যান্টিন পরিচালনা নিয়ে কর্মচারীদের সংঘর্ষ, আহত ৫ - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

থমথমে সচিবালয়,ক্যান্টিন পরিচালনা নিয়ে কর্মচারীদের সংঘর্ষ, আহত ৫


মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ পন্থী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ক্যান্টিন পরিচালনা করে আসছিলো।মঈনুল ইসলাম-মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কমিটির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ ধরা পড়ে সমবায়। পরে কমিটির নানা অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়। এঘটনার এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জুন সহকারী সচিব মো. গোলাম রাজ্জাককে সভাপতি করে ১১ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেয় সমবায় কার্যালয়। এ কমিটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও সদস্য হিসেবে রয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না হলেও ঈদের পর থেকেই এই কমিটি চালাচ্ছিল ক্যান্টিন। পরে গত ২৩ জুন আগের কমিটির সম্পাদক মজিবুর রহমান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।

সচিবালয়ে ক্যান্টিন পরিচালনা নিয়ে কর্মচারীদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর সচিবালয়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কর্মচারীদের পরিচালিত দুটি ক্যান্টিনসহ অন্যান্য দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। সচিবালয়ের চার নম্বর পেছনের পদ্মা ক্যান্টিন এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড সচিবালয়ে দুটি ক্যান্টিন, ওএমএসের দোকান পরিচালনা করে আসছিল। এদিকে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমানে জামায়াত পন্থী হিসেবে দাবি করা মো. বাদিউল কবীর ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ এবং অন্য অংশের নেতৃত্বে বিএনপি পন্থী মো. নূরুল ইসলাম ও মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম। চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলন হচ্ছে এ দুটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠন করা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতৃত্বে। গতকাল বুধবার সচিবালয়ের চার নম্বর ভবনের পেছনে পদ্মা ক্যান্টিন বন্ধ রয়েছে। ক্যান্টিনের পাশে মিল্ক ভিটার দোকানটিও বন্ধ। এছাড়া ক্যান্টিনের আশেপাশে খাবারের দোকানগুলো বন্ধ হয়েছে। ৪ নম্বর ভবনের নিচে খাবার ও মুদি-মনিহারীর দোকান এবং ওএমএসের দোকান বন্ধ রয়েছে। ৬ নম্বর ভবনের নিচে ২ নম্বর ক্যান্টিনও বন্ধ। ৪ নম্বর ভবন এবং এর আশেপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নিয়েছেন। এ ভবনের নিচেই সমবায় সমিতির অফিস। সংযুক্ত পরিষদের নুরুল ইসলাম-মুজাহিদ গ্রুপের নেতা-কর্মীদের সচিবালয়ের বিভিন্ন স্থানে জটলা করে আলোচনা করতে দেখা গেছে। সচিবালয় ও ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাংলাদেশ সচিবালয় বহুমুখী সমবায় সমিতির পুরাতন ও বর্তমান এডহক কমিটির মধ্যে ক্যান্টিন পরিচালনা নিয়ে দুই পক্ষের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কি থেকে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে নতুন এডহক কমিটির সমর্থক ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম (৫৮), কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকতা ওবায়দুল রবিকে (৪৫) পুরাতন কমিটির লোকজন এলোপাতাড়িভাবে মাথায় ও শরীরে আঘাত করেন। তার সহকর্মীরা তাদের উদ্ধার করে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এদিকে সচিবালয় সংযুক্ত পরিষদের দাবি, সচিবালয় সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নুরুল ইসলামের ওপর হামলা করেছেন বাদিউল কবীর গ্রুপের কর্মীরা। হামলায় ৫-৭ জন আহত হয়। আহতদের ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কর্মচারী সংগঠনের একটি পক্ষ ক্যান্টিন দখলে নেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। কিন্তু সমবায় সমিতি তাদের নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্ব চালিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু আগের কমিটির (সমবায় সমিতি) নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি সমবায় অধিদপ্তরের নজরে এলে তারা সমবায় সমিতি পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেয়। কিন্তু আগের কমিটি দায়িত্ব হস্তান্তরে টালবাহানা করছিল। যদিও এর আগেই কর্মচারীদের একটি পক্ষ ক্যান্টিন দখল করে পরিচালনা শুরু করে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরও করেছিল সমবায় সমিতির আগের কমিটি। যদিও তারা এ বিষয়ে আদালতে রিটও করে। কর্মচারীরা জানিয়েছেন, রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার আদালতের এই রিটের রায়কে কেন্দ্র করে সমবায়ের আগের কমিটি ও সংযুক্ত পরিষদের বাদিউল গ্রুপ মিলে নুরুল ইসলাম গ্রুপের নেতাকর্মীদের হামলা করে বলে অভিযোগ করেছেন কর্মচারী নেতারা।

সংযুক্ত পরিষদের নুরুল ইসলাম গ্রুপের মহাসচিব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, গত মঙ্গলবার বিকেলে সমবায় সমিতির আগের কমিটি আদালতের রায়ের বিষয়টি আমাদেরকে জানায়। আমরা বলেছি, এটি তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমবায় বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের জানাক। তারা ক্যান্টিনের কার্যক্রম বন্ধ করতে বললে আমরা বন্ধ করে দেবো। তিনি বলেন, এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে যখন ক্যান্টিনের বাজার এসেছিল, ট্রাক থেকে ওএমএসের পণ্য নামানো হচ্ছিল। তখনই বাদিউলরা আমাদের ওপর হামলা করে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দোসররাও ছিল। তারা ৩০/৪০ জন মিলে আমাদের ওপর রড, লাঠিসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। আমাদের সভাপতি নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন আহত হয়েছে। আমিও আহত হয়েছি। আমাদের সভাপতির (নুরুল ইসলাম) মাথা ফেটে গেছে তিনি এখনো হাসপাতালে ভর্তি। চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন বানচাল ও সমবায় সমিতির আর্থিক দুর্নীতি ঢাকতে পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গতকাল বুধবার বিকালে সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর বলেন, নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির কারণে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটবে না। কর্মচারীদের দুই অংশ নিয়ে আন্দোলনে গঠিত বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কার্যক্রমও চলমান থাকবে। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার রাতে সচিবালয়ে ক্যান্টিন পরিচালনার দখল নিয়ে মারামারি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি নূরুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ কয়েকজন আহত হন। নূরুল ইসলাম ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যানও বটে। বাদিউল কবীরের গ্রুপের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছে নূরুল ইসলাম গ্রুপ।

সংযুক্ত পরিষদের বাদিউল গ্রুপের মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, গতকালকে ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। আমি যতটা শুনেছি, এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। কর্মচারী নেতারা জানিয়েছেন, ঈদুল আজহার পর নুরুল ইসলাম গ্রুপের নেতা-কর্মীরা ক্যান্টিন পরিচালনা করে আসছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পরিপ্রেক্ষিতে তারা পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়েছে। এর আগে অভিযোগ জানালে সমবায় সমিতির বর্তমান কমিটির নানা অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়। তদন্তে সমবায় কার্যালয় মঈনুল ইসলাম-মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কমিটির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জুন সহকারী সচিব মো. গোলাম রাজ্জাককে সভাপতি করে ১১ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেয় সমবায় কার্যালয়। এ কমিটিতে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও সদস্য হিসেবে রয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না হলেও ঈদের পর থেকেই এই কমিটি চালাচ্ছিল ক্যান্টিন। পরে গত ২৩ জুন আগের কমিটির সম্পাদক মজিবুর রহমান মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। যদিও আর্থিক ক্ষমতা পরবর্তীতে হস্তান্তর করেন। ঈদের পর ক্যান্টিন দখলে সমবায় সমিতির আগের কমিটি আদালতে একটি রিট আবেদন করে। আদালত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে বলে জানান সমবায় সমিতির নেতারা।

Top