অন্তরের গভীরে মা-বাবার প্রতি সদাচার জায়গা করে নিলে তা সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত হয়
আলোকিত বার্তা :অন্তরের গভীরে মা-বাবার প্রতি সদাচার জায়গা করে নিলে তা সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত হয়। সে দুর্গ রক্ষা করে অহঙ্কার, কঠোরতা, অবাধ্যতা ও খারাপ কাজ থেকে। মা-বাবার প্রতি সদাচার এমন একটি শক্তিশালী গুণ, যা সব ধরনের খারাপ ও নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে রক্ষা করে। মা-বাবার প্রতি সদাচারী কাউকে মন্দ স্বভাবের দেখা যায় না। আবার মন্দ স্বভাবের কাউকে মা-বাবার প্রতি সদাচারী হতে দেখা যায় না। খলীফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রাহ.) ইবনে মেহরানকে খুব সুন্দর বলেছেন, ‘মা-বাবার অবাধ্য কারো সঙ্গী হয়ো না। সে তোমাকে গ্রহণ করবে না। কারণ সে ইতোমধ্যেই মা-বাবার অবাধ্য হয়েছে।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা অহঙ্কার ও মা-বাবার প্রতি সদাচারের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। যেমন তিনি ইয়াহইয়া (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘সে (ইয়াহইয়া আ.) নিজ পিতা-মাতার খেদমতগার। সে অহঙ্কারী ও অবাধ্য ছিল না।’ (সূরা মারইয়াম-১৪) যেমন আল্লাহ তা‘আলা ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারে বলেছেনÑ ‘এবং আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত বানিয়েছেন। আমাকে উদ্ধত ও রূঢ় বানাননি।’ (সূরা মারইয়াম-৩২) মা-বাবার মতো কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না। তারা নিজ জীবন থেকে জীবন নিয়ে তোমাদেরকে দান করেন। হ্যাঁ, তুমি যা চাও তারা সব তোমাকে দিতে পারবেন না। কিন্তু তাদের যা আছে তার সবই তোমাকে দিয়ে দিয়েছেন।
মা-বাবার প্রতি সদাচার সন্তানের কাঁধে আমানত, যতদিন মা-বাবা জীবিত আছেন। সদাচার পুরোনো হয় না। এর পুরোনো হওয়া উচিতও না। বরং দিন ও বছরের ব্যবধানে এর সৌন্দর্য, দৃঢ়তা ও নতুনত্ব বৃদ্ধিই পায়। মা-বাবার প্রতি সদাচার সবসময় নবীন ও সজীব হতে হবে। মা-বাবা প্রবীণ হয়ে গেলেও সদাচার প্রবীণ হতে পারে না। মা-বাবা যেন সন্তানের কাছে বোঝা না হয় যে, মা-বাবাকে সন্তানরা নিজেদের মাঝে ঠেকায় পড়ে ভাগাভাগি করে নেবে; দায় থেকে বের হওয়ার জন্য, সমালোচনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।আসলে মা-বাবার প্রতি সদাচার দ্বীনও-দাইনও; অর্থাৎ ধর্মও আবার ঋণও। এটা দ্বীনী ও অপার্থিব প্রতিযোগিতা। সদাচারী সন্তান এতে স্বাদ অনুভব করে। এটা যেন তাকে জান্নাতের কোনো এক দরজায় নিয়ে যায়। এমনিভাবে এটা পার্থিব ঋণও, তথা মা-বাবার কৃত অনুগ্রহ, যা তার জিম্মায় রয়ে গেছে; সে তা পরিশোধ করে। এ ঋণ যতই পরিশোধের চেষ্টা করা হোক না কেন, তা শোধ হবার নয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ইয়েমেনের এক লোককে দেখলেন, মাকে কাঁধে বহন করতে। মাকে কাঁধে নিয়ে তাওয়াফ করতে করতে বলছিল, আমি মাকে বহন করা অনুগত উট। তাঁর উট আতঙ্কিত হলেও আমি আতঙ্কিত হই না। আল্লাহ আমার রব, মহা পরাক্রমের অধিকারী। মা আমাকে যতদিন গর্ভে ধারণ করেছেন তার চেয়েও বেশি আমি তাঁকে বহন করেছি। হে ইবনে উমর, তোমার কী মনে হয়, আমি তাঁর প্রতিদান দিতে পেরেছি? তিনি বললেন, না, জন্মের সময় তার একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রতিদানও দিতে পারনি। (আল আদাবুল মুফরাদ, পৃষ্ঠা-১৮)আমাদের পূর্বসূরিগণ মা-বাবার প্রতি সদাচারের অনন্য উপমা পেশ করেছেন। মা-বাবার অনুগ্রহের সামনে নিজেদের সদাচারকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। মদীনায় হাজারো খেজুর গাছ ছিল। উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) নির্দিষ্ট একটি খেজুর গাছের মজ্জা কেটে আনলেন। কেউ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার মা এটা আমার কাছে চেয়েছেন। আমার সাধ্যের মধ্যে মা যা চান আমি করে দিই। (মাকারিমুল আখলাক, পৃষ্ঠা-৫৫)
আবু হুরায়রা (রা.) ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে মাকে বলতেন, মা আপনার ওপর শান্তি ও রহমত নাযিল হোক। মা বলতেন, তোমার ওপরও শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল হোক। তিনি বলতেন, আল্লাহ আপনাকে রহম করুন যেমন আপনি আমাকে রহম করে ছোট বেলায় লালন-পালন করেছেন। মা বলতেন, তোমার প্রতিও আল্লাহ রহম করুন যেমন তুমি আমার সঙ্গে বৃদ্ধ বয়সে সদাচার করছ। (আল আদাবুল মুফরাদ, পৃষ্ঠা-১৮)
মা-বাবার অবাধ্য সন্তান কি জানে, এ অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে। নবী কারীম (সা.) যে ব্যাপারে বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহের কথা বলব না? একথাটি তিনি তিনবার বলেন। সাহাবীগণ বললেন, নিশ্চয়ই ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, তিনি হেলান দেয়া ছিলেন, বসে বললেন, সাবধান! আরেকটি হলো, মিথ্যা বলা। (সহিহ বুখারী-২৬৫৪) আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে মা-বাবার প্রতি সদাচারী হওয়ার তাওফীক দান করুন।