বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চান - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চান


মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন :বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ প্রভাবমুক্ত ও পেশাদার পুলিশ চান। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা কখনো তা চাননি। ১৯৩০ সাল থেকে দমন করাই ছিল পুলিশের কাজ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয় না। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আর এজন্য পুলিশ সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়।বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ অডিটরিয়ামে পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষ্যে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ : নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বিশিষ্ট নাগরিকদের বক্তব্যে উঠে আসে এমন দাবি। পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা রাখার আহ্বান জানানো হয়। মতবিনিময় সভায় পুলিশ সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম ও প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনা করেন অনেকে।এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সব মহানগর পুলিশের কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় শিক্ষক, সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, লেখক, খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, শ্রমিকনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।

তিন দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানের শেষ দিনে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আগে সকালে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আইজিপি বাহারুল আলম।এ সময় তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, এখন আমি না বলা শিখে গেছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, উপদেষ্টা বা ঊর্ধ্বতন মহল থেকে কাউকে বদলির তদবির আসলে আমি সংশ্লিষ্ট এসপি বা ইউনিট চিফের সঙ্গে কথা বলি। ওই কর্মকর্তার বিষয়ে বিস্তারিত জেনে যদি দেখি সে ভালো তাহলে বদলির তদবিরকারীকে বিষয়টি জানিয়ে দেই। এদিন দুপুরে নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পুলিশের সাবেক দুজন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বক্তব্য দেন। সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। পুলিশকে একটি দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সবচেয়ে বেশি দরকার।নুরুল হুদা আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে রাজনীতিবিদরা সবকিছুর পরিবর্তন করলেন কিন্তু দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন পরিবর্তন করলেন না। অথচ সেগুলো যুগের দাবি ছিল। এর মানে হলো তখনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না। তিনি বলেন, ‘এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমরা একাত্তরেও দেখিনি। আমাদের যে সংবিধান আছে, সেটি অপারেশনাল করতে হলে যেসব রুলস-রেগুলেশন পরিবর্তন করা দরকার ছিল, সেগুলো আমরা করলাম না। এর মানে আমাদের কথায় বৈপরীত্য রয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা পুলিশকে যথাযথভাবে পেশাদার করতে চাননি।’

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব কথাবার্তা বলা হয়েছে, এগুলো সাত দিনেই তৈরি করা যায়। বর্তমান আইজিপিও সংস্কার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কমিশন কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেছে। নিরীক্ষার কথা বললেই ভয়ের বিষয়। যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষারই দরকার হয়, তাহলে এই কমিশনের দরকার ছিল কি?সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবাই স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতা দিলে ভালো লাগে না। তখন গোলামি ভালো লাগে। অনেকেই গোলামি করতে চায়। পদোন্নতি-পদায়নের জন্য মন্ত্রীদের বাসায় গিয়ে গোলামি করতে চায়। এ দ্বিচারিতার অবসান হওয়া উচিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, পুলিশ যে একরকম অদ্ভুত অবস্থায় আছে, তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। এর কারণ অনুসন্ধানের মতো উদার চিন্তা থাকা উচিত। পুলিশ দলীয় পুলিশ হয়ে যায়, সেটা তো বাহ্যিক। কিন্তু ভেতরে সমস্যা আছে।

তিনি আরও বলেন, যাকে রাষ্ট্র বলা হয় তার একটি শাখা হলো বলপ্রয়োগ। পুলিশ যেহেতু এই বলপ্রয়োগের কাজটি করে, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তাদের এ কাজটি অজনপ্রিয়। তবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত রাষ্ট্র আছে, সব কটিতেই পুলিশ লাগে। পুলিশ কথার মধ্যেই রাষ্ট্র কথাটা লুকিয়ে আছে। তিনি আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে না। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এটা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।আইজিপি বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান। সমাপনী বক্তব্য দেন মতবিনিময় সভা-সংক্রান্ত উপকমিটির সভাপতি ও পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল।

সূচনা বক্তব্যে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই ইতিবাচক হয়, যখন মানুষ দেখে এই বাহিনী কেবল আইন প্রয়োগ করছে না, বরং জনগণের অধিকার রক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করছে। ‘জনতার পুলিশ’ মানে শুধু একটি পরিচয় নয়, এটি একটি দর্শন, যা নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে জনমনে আস্থা, শ্রদ্ধা ও সম্মান গড়ে তোলে।সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেন, রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে, তখন পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে দেয় না। অতীতে দেখা গেছে, রাষ্ট্র কতটা নির্লজ্জ হলে, পুলিশ সদস্যদের পদক দেওয়ার কারণ হিসাবে বিরোধী দলকে দমন করার কথা উল্লেখ করা হয়। তার মতে, পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মতো বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে। যারা আন্দোলনে যায়, তাদের কথাগুলো পুলিশকে বুঝতে হবে।নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য (শিক্ষার্থী প্রতিনিধি) মো. জারিফ রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার আশফাক নিপুন, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মানজুর আল মতিন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।

Top