সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
মোহাম্মাদ মহাব্বাতুল্লাহ মাহাদ :সংসদ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চার বছর মেয়াদের প্রস্তাব দিলেও জামায়াত চায়, এই মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকুক। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে দলটি। এ দুই বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মতের মিল রয়েছে। এক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী চায় না জামায়াত। এক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে একমত পোষণ করে দলটি বলেছে, এটি পরপরও হতে পারে। বিএনপির প্রস্তাব ছিল পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। পরে এক মেয়াদ বাদ দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে মত দেয় দলটি। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চেয়েছে জামায়াত, যা বিএনপি চায় না। এদিকে বিএনপির মতো জামায়াতও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে, সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ চায় না। উভয় দল মূলনীতি হিসাবে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল চায়। শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় এসব মতামত জানিয়েছে জামায়াত।আলোচনা শেষে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘ সময় আলোচনার পরও আলোচনা অসমাপ্ত রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তাড়াহুড়ো করছি না। অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিছু বিষয়ে একমত হতে পেরেছি। কিছু বিষয়ে আংশিক একমত হয়েছি।কিছু বিষয়ে তাদের (ঐকমত্য কমিশন) প্রস্তাব দিয়েছি। সেটা উনারা বিবেচনার জন্য রেখেছেন। কিছু বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন। সেগুলো পরের আলোচনার জন্য রেখেছি। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। অর্থাৎ দশ বছরের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। তা পরপরও হতে পারে।সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, দুই নম্বরে আমরা একমত হয়েছি, আর্টিকেল ৭০-এর কিছু অ্যামেন্ডমেন্টসহ উনাদের (ঐকমত্য কমিশন) প্রস্তাবের সঙ্গে। সেটি হচ্ছে, সংবিধান পরিবর্তন, অর্থবিল বা বাজেট অনুমোদন এবং আস্থা ভোট ছাড়া বাকি যে কোনো বিষয়ে একজন সংসদ সদস্য যে কোনো দলের ও মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। কিন্তু পাওয়ার এবং অথোরিটির জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন। আমরা সেটি বলেছি। উনারাও আলোচনার জন্য অগ্রসর হয়েছেন। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে এনসিসি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেখানে তারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির কথা বলেছেন। আমরা তাতে না বলেছি। উনারা দুজন রাষ্ট্রের দুটি সর্বোচ্চ জায়গায় আছেন। দেশে জরুরি অবস্থায় অনেক সময় রাষ্ট্রপতির কাছে ধরনা দিতে হয়, অনেক সময় জুডিশিয়াল সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। তাই উনাদের কমিটির ভেতর অন্তর্ভুক্ত না করাই ভালো হবে।তিনি বলেন, আমরা পিআর সিস্টেমে নির্বাচনের কথা বলেছি। তার মানে সারা দেশে একসঙ্গে নির্বাচন হবে মার্কা বা দলের ভিত্তিতে। সারা দেশে যে দল যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই পরিমাণে সংসদে আসন নির্ধারিত হবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের নির্বাচনে যে দুর্নীতি, জবরদখল হচ্ছে এবং ভোটবিহীন নির্বাচনের যে ফলাফল হচ্ছে, এটি তখন বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার খেলাও বন্ধ হয়ে যাবে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত জামায়াত। সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, সংসদে উচ্চকক্ষ ও নিুকক্ষ থাকবে। ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য আমরা এতে একমত হয়েছি।সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুরে বিরতি দিয়ে বৈঠক চলে সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত। ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের নেতৃত্বে জামায়াতের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ।ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে আলোচনায় অংশ নেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর মতামত নেওয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট মতামত জানাতে অনুরোধ করে সুপারিশগুলোর স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩৫টি দলের কাছ থেকে মতামত পেয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ এ পর্যন্ত ১৭টি রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আজ গণসংহতি আন্দোলন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সঙ্গে বৈঠক রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।
লক্ষ্য একটি জাতীয় সনদে পৌঁছানো-আলী রীয়াজ : আলোচনার গুরুত্ব তুলে ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটি জাতীয় সনদে পৌঁছানো। কিন্তু এই মুহূর্তটিকে ঐতিহাসিক জ্ঞান করে আমরা যেন সুযোগ হাতছাড়া না করি। নতুন বাংলাদেশে কেউ যেন নিপীড়নের শিকার না হয়, বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থা না থাকে। আমাদের এই পথচলায় সবাই অংশীদার। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ, সিভিল সোসাইটি ও গণমাধ্যম। আমাদের সবার দায়বদ্ধতা ও যৌথ প্রচেষ্টাই আমাদের সাফল্য নির্ধারণ করবে। এই সংস্কার প্রক্রিয়া কারও একার বিষয় নয়, এটি পুরো জাতির বিষয়।
তিনি বলেন,রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কেবল সরকারের একক সিদ্ধান্ত নয়, বরং তা জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। রাজনৈতিক দল, ছাত্র সমাজ, সাধারণ মানুষ সবার পক্ষ থেকেই এ প্রক্রিয়ার তাগিদ এসেছে। জামায়াতকে উদ্দেশ করে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আপনাদের কর্মী-নেতারা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন। এরপরও সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছেন, সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন সেজন্য অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপনাদের অবদান নিঃসন্দেহে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আশা করি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথচলায় আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় জামায়াতের নেতাকর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রাণও দিয়েছেন। আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করেন, সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবের মূল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। প্রয়োজনে তা চলমান থাকবে। লক্ষ্য একটাই-একটি অধিকতর ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন।