বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত গুম, খুন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ
মোহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম:গুম হত্যার চেয়ে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত গুম, খুন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ঘটনাগুলোকে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সেজন্য আমরা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করছি। একই সঙ্গে আমরা বিচার প্রক্রিয়াও শুরু করেছি। মঙ্গলবার রাজধানীর কলেজ রোডে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সেমিনার হলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রস্তাবিত ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর ওপর এই সভার আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়।ড. আসিফ নজরুল বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন এমন অপরাধ আর না হয়, এজন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ও প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হবে। তিনি বলেন, অনেকে প্রশ্ন করেন যে আইনগুলো করছেন, পরবর্তী সরকার এসে এগুলো রাখবে কিনা। কারণ এক-এগারো সরকারের আমলেও অনেক ভালো আইন করা হয়েছে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেগুলো আর রাখেনি। আমি সবাইকে বলি, পরে যে সরকার আসবে, তারা কমপক্ষে এক হাজার মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে গঠিত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে আসবে। তাদের পেছনে থাকবে ৫০-৬০ হাজার মানুষের আহত হওয়ার স্মৃতি। লাখ লাখ মানুষের কান্না। এতবড় একটা লিগ্যাসির পর আমাদের পরবর্তী সরকার আমাদের এই সংস্কার ভুলে যাবে, এটা আমি কল্পনাও করতে চাই না।
আইন উপদেষ্টা বলেন, গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো তাদের দোয়াও করতে পারেন না। তারা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, তা পরিবার জানে না। আমরা দেখেছি, গুমের শিকার একজনের বাবা বলেছিলেন, আমি কোনো বিচার চাই না। শুধু আমার ছেলের কবর কোথায় আছে, তা জানতে চাই। তিনি বলেন, আমাদের সরকারের যত অগ্রাধিকার রয়েছে, তার মধ্যে গুম, খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের ইতিহাসে যে নৃশংসতম ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার বিচার নিশ্চিত করা অন্যতম।আসিফ নজরুল বলেন, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আপনাদের অনেক ধরনের উৎকণ্ঠা থাকে, চিন্তা থাকে, এখানে কোনো বিলম্ব করা হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, আমার মনে হয় না, এখানে আমাদের কোনো গাফিলতি রয়েছে। আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, এটা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে।উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে আমাদের তরুণ, ছাত্র-জনতার অসীম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার একটি সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগের কারণেই আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার একেবারে প্রথম দিকেই কোনো কালবিলম্ব না করে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে আমরা পক্ষরাষ্ট্র হয়েছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো রিজার্ভেশন ছাড়া এতবড় মানবাধিকার কনভেনশনের আমরা পক্ষরাষ্ট্র হয়েছি।
আমরা গুম আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পক্ষরাষ্ট্র হয়েছি কিন্তু আমাদের দেশে গুমসংক্রান্ত বিষয় বিচার করার জন্য কোনো ডেডিকেটেড আইন নেই, এটি হতে পারে না। আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিস্তৃত এবং সুসংঘটিত গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে দেখা হলেও এর বাইরে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে গুমের আলাদা কোনো সংজ্ঞা বা তার শাস্তির কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া নেই। এই শূন্যতাকে দূর করার জন্য আমরা এই পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, আমাদের বিশেষজ্ঞ ও আলোচকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুতই এই আইনের একটি খসড়া তৈরি করে যথাযথভাবে তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। এ সময় গুম তদন্ত কমিশনের বিষয়ে তিনি বলেন, কমিশন দিন-রাত কাজ করেছে এবং খুব শিগগিরই তারা তাদের রিপোর্ট জমা দেবে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল প্রসিকিউটরিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী, আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলম, ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেলিন প্রমুখ।