সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো


মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দিনভর আলোচনা করেছে বিএনপি। কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না-সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। দলটি মনে করছে, টানা দুবারের বেশি না পারলেও বিরতি দিয়ে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে, সে সুযোগ থাকতে হবে। এটা সংকুচিত করার যৌক্তিকতা নেই। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যমান ক্ষমতা বহাল রেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশে একমত হয়েছে বিএনপি।এতে বেশকিছু বিষয়ে একমত হলেও, কয়েকটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে দলটি। সেক্ষেত্রে কিভাবে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়েও মতামত জানিয়েছে বিএনপির প্রতিনিধিদল। মঙ্গলবার ফের ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। এর আগে বৃহস্পতিবার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে দলটি।রোববার বৈঠক শেষে দুদফা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ ৫ বছর রাখার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা বলেছি, পরপর দুবারের বেশি কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। যদি দুবারের পর একবার গ্যাপ হয় তার পরবর্তীকালে জনগণ যদি সেই দলকে নির্বাচিত করে; সেই পার্টি মেজরিটি পেয়ে যদি ডিসাইড করে তাহলে সেই একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতেও পারেন। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, কেন আপনারা ধরে নিচ্ছেন যে, সেইম লিডার বারবার হবেন। আমরা অপশনটা রাখতে চাই যে, বাধ্যবাধকতা করা যাবে না।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ-সদস্যদের ক্ষেত্রে আমরা শুনেছি আস্থা বিল এবং অর্থবিলের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একমত। রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে এবং সরকারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা চারটা বিষয় এখানে উল্লেখ করেছি। অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন-এই চারটা বিষয় বাদে সংসদ-সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন বলে সুপারিশ করেছে বিএনপি। তাতে তাদের সংসদ-সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে না।সংসদে নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই বিষয়ে বিএনপি একমত। কিন্তু এখন যেমন আছে, সেটা আগামী সংসদ পর্যন্ত বহাল থাকতে হবে। আগামী সংসদ গঠিত হওয়ার পর তাদের (নারীদের) কোন পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল-একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না। তবে বিএনপি এই প্রস্তাবে একমত নয় বলে জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, তারা এই বিষয়টি ‘উন্মুক্ত’ রাখার প্রস্তাব করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্যসহ অনেক গণতান্ত্রিক দেশে পার্টি প্রধানই সরকারপ্রধান হন এবং এটি একটি গণতান্ত্রিক চর্চা। এখানে প্রশ্ন এসেছে যে, লিডার অব দ্য হাউজ কি একই ব্যক্তি হবে। আমরা বলেছি যে, পার্টি চিফকেই যে প্রধানমন্ত্রী করবে সেটা আরেকজনকেও তো করতে পারে, অপশন থাকা উচিত। মেজরিটি পার্টি থেকে প্রধানমন্ত্রী হলেও যে সংসদ নেতা হবে কি হবে না, অন্যজন হতে পারে, সেটাতেও অপশন রাখা উচিত। আমরা এসব অপশন খোলা রাখতে বলেছি ডেমোক্রেটিক প্র্যাকটিসের জন্য।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রসঙ্গে একমত জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বলেছি যে, রাষ্ট্রপতির বিদ্যমান ক্ষমতার বাইরে আর কী কী বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া যায়, আইন প্রণয়ন করা যায় সেসব কিছু বিষয়ে এবং নিয়োগের কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। সেক্ষেত্রে সংসদে নতুন আইন করা যাবে। সেক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং রাষ্ট্রপতির আরও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হবে। এর জন্য আলোচনার প্রয়োজন।স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এমন প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে-ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভার মতো স্তরগুলোতে যে কোনো সংস্কারের পক্ষে তাদের অবস্থান রয়েছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হবে।ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা এটার বিপক্ষে মতামত দিয়েছি। বিএনপি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। বর্তমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদের বিষয়টি নেই। তবে, কমিশন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের কথাগুলো যুক্ত করার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বিএনপি একমত হয়েছে।

উচ্চকক্ষে আসন সংখ্যা ১০০ রাখার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে বিএনপি। উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, কারা আসবে, আনুপাতিক হারে আসবে কিনা সে বিষয়ে বিএনপি বলেছে যে, আগে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সংশোধনীটা সংসদে গৃহীত হোক। দ্বিকক্ষ গঠন হলে পরে সংসদে আলাপ করে এ বিষয়ে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা ভালো হবে।কেয়ারটেকার সরকারের বিধান রাখার বিষয়ে বিএনপি সম্মত হলেও, এর মেয়াদ ৯০ দিন হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, আমাদের পলিটিক্যাল হিস্ট্রি ও কালচারে দেখা গেছে উইদাউট কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট আমরা কোনো ইলেকশনই অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু করতে পারি না। যতদিন পর্যন্ত আমরা সেই কালচারে উপনীত না হতে পারব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকারের বিধানটা রাখা উচিত। এই ভোটের জন্য আমরা ১৫ বছর আন্দোলনও করেছি।

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) বিষয়েও একমত নয় বিএনপি। দলটির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা বাস্তবায়ন হলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অনেক বেশি সংকুচিত হবে।সংস্কার কমিশনের মৌলিক অধিকারের পরিসর বৃদ্ধির বিষয়ে মতামত দিয়েছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন বলেন, মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। এটার পরিধি বাড়ালে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যয় বাড়বে। তাই আমরা অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত না করে রাষ্ট্র যেটুকু বহন করতে পারবে, সেটুকুই নির্ধারণের পক্ষে জোর দিয়েছি। ইন্টারনেট প্রাপ্তিকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসাবে সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শুরু হয়েছে আর্টিকেল ৮ থেকে ২৫ পর্যন্ত। আর মৌলিক অধিকার আর্টিকেল ২৬ থেকে ৪৭ পর্যন্ত। মৌলিক অধিকার অনুযায়ী যেসব বিষয় উল্লেখ থাকে, এটা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। সেজন্য আমরা বলেছি এখানে অনেক জিনিস অন্তর্ভুক্ত না করে, যেসব বিষয়গুলো রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারবে, রাষ্ট্রের সক্ষমতা অনুসারে সেগুলোকে আনা এবং বাস্তবায়ন করা হোক। এ ব্যাপারে উনারা একমত হয়েছেন এবং সেগুলোকে ড্রাফট আকারে আমাদেরকে দেবেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো প্রাথমিকভাবে সংসদে উপস্থাপনের কথা উনারা বলেছেন। আমরা বলেছি, এটা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। বাণিজ্যিক চুক্তি বাইলেটারাল চুক্তি, বিনিয়োগ চুক্তি আছে-যেগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নরমাল প্র্যাকটিস। চুক্তির পরে সংসদে উপস্থাপনের যে বিধান যেটা আমরা যেন প্রয়োগ করি।

‘ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএনপি বিদ্যমান আইনের যথাযোগ্য যুগোপযোগী করার জন্য নীতিগতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে একমত হয়েছে’ বলে জানান সালাহউদ্দিন। প্রার্থীদের ন্যূনতম বয়স ২১ করার ক্ষেত্রে বিএনপি একমত হয়নি। দ্বিমত পোষণ করেছে।জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পঞ্চদশ সংশোধনী প্রসঙ্গ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ পদ্ধতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়ে আরও আলোচনা চলবে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ।বিচার বিভাগ ও সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো পরবর্তী আলোচনায় চূড়ান্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা সংস্কারের বিষয়ে ইতিবাচকভাবে কাজ করছি। রাষ্ট্রের গণতন্ত্র রক্ষায় বিএনপি সরকার ও কমিশনকে সহযোগিতা করতে চায়।ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকা দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি। আলোচনা মোটামুটি ভালো এগোচ্ছে। বেশকিছু বিষয়ে কাছাকাছি এসেছি, বেশকিছু বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বাকশালে বিশ্বাস করি না যে, এমন কিছু করা হবে যেটা সবাইকে বাধ্য হওয়া লাগবে। আমরা মনে করি, দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে যা সংগত যা সর্বাপেক্ষা উত্তম, তেমন কিছুই হওয়া উচিত, করা উচিত।’

রোববার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব মনিরুজ্জামান খান।জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন-বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। এদিন আলোচনা শেষ না হওয়ায় আগামী ২২ এপ্রিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আবারও বিএনপির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

Top