নির্বাচনের বয়ান ভারতের,হাসিনা ও আ.লীগের পুনর্বাসনই উদ্দেশ্য - Alokitobarta
আজ : বুধবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনের বয়ান ভারতের,হাসিনা ও আ.লীগের পুনর্বাসনই উদ্দেশ্য


মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া :বাংলাদেশে দ্রুত এবং ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের পক্ষে ভারতের অবস্থান এখন প্রকাশ্য। যদিও আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক না হলেও দেশটি কোনো কথা বলেনি, বরং সমর্থন দিয়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।তাদের মতে, ভারতের এ মুহূর্তের অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনধিকার চর্চা, যা কূটনীতির শিষ্টাচারবর্জিত এবং এর নৈতিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। ফলে ভারত এখন যে বক্তব্য দিচ্ছে, তা বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল। এর মধ্য দিয়ে সেই দেশে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায়। আর এ কারণেই তাকে (হাসিনা) ফেরত চাওয়ার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না; উলটো আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছে। সেখানে (ভারতে) বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় শেখ হাসিনা নানা ধরনের বক্তব্য দিলেও বাধা দেওয়া হচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করা এবং ২০২৪ সালে একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনের পরও সঙ্গে সঙ্গে অনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। তখন তাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছিল-নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তারা ‘স্থিতিশীল বাংলাদেশ’ দেখতে চায়।কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই যেন তাদের সেই আগের বয়ান পুরো পালটে যায়। এখন আগ্রহ জানাচ্ছে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে। হরহামেশাই বলছে বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক যাত্রা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের কথা।সর্বশেষ বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ভারত বারবার বলেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ সম্পর্ক চায়।গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বাংলাদেশ দেখতে ভারত আগ্রহী বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে ৭ মার্চ দেশটির জয়সওয়াল বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের প্রসঙ্গে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। এর কিছুদিন আগে একই ধরনের অভিমত দিয়েছিলেন দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধানও।অন্যদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘গত সপ্তাহে আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিয়ে একটি ঘোষণা দিয়েছি। এ পদক্ষেপ নিয়েছি আমাদের বন্দর ও বিমানবন্দরগুলোয় জটের কারণে। তবে আমি এ বিষয়টিও আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা এসব পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বাংলাদেশের পক্ষে যেসব ঘটনা ঘটেছে, অনুগ্রহ করে সেগুলোর দিকে তাকান।’

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের এ চাপ বা বক্তব্য যাই বলেন, এর নৈতিক ভিত্তি তো আসলে শক্তিশালী নয়। এর কারণ, দেশটি এখন এ কথা বললেও গত তিনটি নির্বাচন যখন অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন তো এসব কথা বলেনি। ফলে তাদের নৈতিক ভিত্তিটা খুবই দুর্বল। দ্বিতীয় বিষয় যেটা হচ্ছে তা হলো-বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে, সেটা বাংলাদেশের জনগণ, সরকার, আমরা বিচার করব। এখানে মনে রাখতে হবে, অন্তর্ভুক্তিমূলকের সঙ্গে সঙ্গে দায়বদ্ধতার বিষয়টিও জড়িত আছে। ফলে তারা যখন অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলে, তখন এখানকার দায়বদ্ধতার কখাটাও বললে আমার মনে হয় তা অধিক যুক্তিসংগত হয়।

শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়া এবং সেখানে বসে তার বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেটা তো আমাদের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডের সুযোগ যেন তারা (ভারত) না দেয়। এটা যে বাংলাদেশের জন্য খানিকটা অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি মনি করি, তারা (ভারত) যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক গতিতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাদের দিক থেকেও দায়িত্ব আছে। আমরা সবাই ভুল করি। এখন অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার আলোকে তারা যদি সম্পর্কটা দেখে, আমি মনে করি সেটা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম শহিদুজ্জামান বলেন, এটা দমনমূলক কূটনীতি। মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিয়ে একধরনের মিথ্যা মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে চাওয়া। প্রথম কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু তারা (ভারত) বারংবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগকে আবারও রাজনীতিতে ফেরত পাঠানো। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও তাদের অনুচর রয়েছে। ভোট কারচুপি করার উপায় এখনো খোলা রয়েছে। কারণ, সংস্কারকাজ হয়নি। ফলে তারা চাইছে আবারও আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাধ্যমে একটা প্রক্রিয়ায় যেন ঢুকানো যায়। এটাই তাদের উদ্দেশ্য।

তিনি আরও বলেন, তারা শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাচ্ছে না। এটা করছে গায়ের জোরে। তারা আন্তর্জাতিক আইনকে ভ্রুক্ষেপ করে না। তারা নিজেদের স্বার্থে শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশের প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ববোধ নেই। তারা আগে অবৈধ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলে এখন তারা যেটা বলছে, সেটা চাপ সৃষ্টির জন্য এবং নগ্ন হস্তক্ষেপ করার ষড়যন্ত্র। তারা মিথ্যাচারে লিপ্ত এবং প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। তাদের এই অবস্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্য কেউ একমত নয়। তারা এটার নিন্দা করে।

সাবেক সচিব ও রাজনীতি বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান বলেন, আমার মনে হয় না এটা কোনো চাপ তৈরি করতে পারবে। আর তারা চাপ তৈরি করতে চাইলেই আমরা সেটা মেনে নেব কেন? আমি মনে করি, দুই দেশের সম্পর্কের যে জায়গা, তাতে কিছু ঝামেলা হচ্ছে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তো শুধু ভারত নয়, জাতিসংঘও বলছে। কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা যাবে না, এটাও বলেছে। ফলে এগুলো হচ্ছে আলাপ-আলোচনার বিষয়।

শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়া এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের চিঠির জবাব না দেওয়া এমন ইঙ্গিত দেয় কি না যে তারা তাকে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে আবারও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করতে চায়-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তারা ফেরত দেবে না, এটা বোঝা যায়। তারা বাংলাদেশের চিঠির উত্তর দেয়নি। তারা তাকে (শেখ হাসিনাকে) বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোর বিষয়ে বন্দি প্রত্যর্পণ আইনের অনেক ধারাই ব্যবহার করবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের পরিচালক প্রফেসর ড. এম জসিম উদ্দিনবলেন, ‘গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনে ভারতের যে বয়ান, তা বাংলাদেশের ওপর অযাচিত চাপ বলেই আমি মনে করি, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে-ভারত আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর কে? ১৭ বছর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যে রাষ্ট্রটি হত্যা করেছে। ফলে এটা ভূতের মুখে রাম নামের মতো। ভারতের উচিত এই ধরনের বয়ান পরিবর্তন করা।

যদি তারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কারণ ১৭ বছর ভারত যেভাবে একটি ফ্যাসিস্ট দলকে সমর্থন জুগিয়ে গেছে, সেই ইমেজকে যদি তারা ভোলাতে চায়, তাহলে আমি বলব-ভারতের উচিত কিছুদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে এ ধরনের স্টেটমেন্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। ভারত যখন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের কথা বলে, তখন তারা যে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করতে চায়-বাংলাদেশের মানুষও এমনটাই মনে করেন, মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।

Top