ঈদের ছুটিতে পাঁতানো দরপত্র কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের
মোহাম্মাদ মহাব্বাতুল্লাহ মাহাদ: গত ২৭ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল মোট নয় দিন ছিল ঈদের সরকারি ছুটি। এই ছুটির মধ্যে দুটি দরপত্র জমা ও উন্মুক্তের শেষ দিন নির্ধারণ করেন ডিএই’র যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পিডি রবিউল ইসলাম। পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটি চলাকালে দু’টি দরপত্র (টেন্ডার) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) এক প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সরকারি ছুটির দিনে এই পাতানো দরপত্রের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। সরকারি ছুটির দিনে দরপত্র জমাদান ও উন্মুক্তের শেষ দিন রেখে প্রকল্প পরিচালক পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যক্ট-২০০৮ (পিপিআর-২০০৮) অনুযায়ী গুরুতর অপরাধ করেছেন বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
জানা যায়, প্রকল্পের পিডির ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া (পরিবহণ সেবা ক্রয়) গত ১৯ মার্চ প্রকল্প পরিচালক দরপত্রে আহ্বানের নোটিশে স্বাক্ষর করেন। একই দিন আবার দৈনিক দেশের কণ্ঠ নামের এক পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়। একই দিনে নোটিশে স্বাক্ষর এবং ওই দিনই কীভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে দরপত্র বিক্রির শেষ দিন রাখা হয় ২ এপ্রিল (ঈদের তৃতীয় দিন) এবং দরপত্র জমাদানের শেষ তারিখ ও উন্মুক্তের তারিখ ৩ এপ্রিল নির্ধারণ নিয়ে। কারণ ২৭ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত এ বছর ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটি ছিল।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যক্ট-২০০৮ (পিপিআর-২০০৮) অনুযায়ী সরকারি ছুটির দিন দরপত্র জমা দানের শেষ তারিখ ও উন্মুক্তের তারিখ নির্ধারণ গুরুতর অপরাধ বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একে তো প্রথম শ্রেণির কোনো দৈনিকে দরপত্রের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়নি, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট দফতরের নোটিশ বোর্ডেও টানানো হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-টেন্ডার হলে সংশ্লিষ্ট সব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সবাই নোটিফিকেশন পেয়ে যান। কিন্তু, ম্যানুয়াল টেন্ডার হওয়ায় (পত্রিকা যারা পড়বে তারা শুধু দেখবে) সুনির্দিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ এই বিজ্ঞাপন দেখেনি। ফলে মেসার্স প্রত্যাশা এন্টারপ্রাইজ ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশ নিতে পারেননি। মেসার্স প্রত্যাশা এন্টারপ্রাইজনামের প্রতিষ্ঠানের একজন মাত্র দরদাতা দরপত্র জমা দেন এবং তিনিই রেস্পন্সিভ দরদাতা হিসেবে গাড়ি সরবরাহের দায়িত্ব পান।
দৈনিক দেশের কণ্ঠ নামের একই পত্রিকায় প্রশিক্ষণ সামগ্রী ক্রয়ের (নোটবুক, ফোল্ডার, কলম, টেনিং মেনুয়াল ইত্যাদি) জন্য গত ২৩ মার্চ একইভাবে দরপত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রেও একইদিনে প্রকল্প পরিচালক দরপত্র আহবানের নোটিশে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ২৬ লাখ টাকা মূল্যের এই দরপত্র বিক্রির শেষ তারিখ ছিল গত ৫ এপ্রিল (শনিবার), সরকারি ছুটির দিন। দরপত্র অনুযায়ী প্রায় ৬ হাজার পিস প্রশিক্ষণ মেনুয়াল, কলম, নোটবুক, ফোল্ডার ইত্যাদি ছাপানোর কাজ এটি। যশোরের রাব্বী প্রিন্টার্স এন্ড স্টেশনারীজ নামের একমাত্র প্রতিষ্ঠানম্যানুয়াল পদ্ধতির এ দরপত্র ক্রয় করে এবং জমা দেয়। এই ধরনের ক্রয় কার্য সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে স্যাম্পল অনুমোদনের বিধান থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি বলেও জানা যায়।
সূত্রে জানায়, ইতোমধ্যে এই দু’টি দরপত্রের কার্যাদেশও দেয়া হয়। তবে, এটি পিডি নিজের কাছেই রেখে দেন। যশোর অঞ্চলে প্রকল্পের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে খরিপ মৌসুমের প্রশিক্ষণ বরাদ্দের কথা জানিয়ে পিডি লেখেন, ‘আগামীকাল সোমবার (আজ) প্রশিক্ষণ উপকরণ সকল উপজেলায় পৌঁছে যাবে। এরপর সকল উপজেলা থেকে ট্রিনিং শিডিউল অবশ্যই প্রকল্পের মেইলে পাঠাতে হবে। শিডিউল না পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করা যাবে না।’
জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ডিএই’র যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পিডি হিসেবে দায়িত্ব নেন রবিউল ইসলাম। দায়িত্ব নেয়ার পর উপরের দু’টির পাশাপাশি আরেকটি দরপত্র আহ্বান করেন। সেটাও অনেকটা ঈদের ছুটির ফাঁদে ফেলা হয়েছে সুকৌশলে। ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরুর ঠিক আগের দিন গত ২৬ মার্চ সৌর আলোক ফাঁদ ক্রয়ে একটি দরপত্র (ই-টেন্ডার) আহ্বান করা হয়। প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ টাকার এই দরপত্রে এমন শর্ত দেয়া হয় যে, ‘জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ এই শর্ত পূরণ করতে পারবে না। গত ৮ এপ্রিল ছিল এই দরপত্র উন্মুক্তের দিন। অর্থাৎ টেন্ডার আহ্বানের পর ১৪ দিনের মধ্যে ৯ দিনই ঈদ-উল-ফিতরের ছুটি ছিল। তাই যন্ত্র সরবরাহের এই কাজটি পান জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ এর অধীনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের বিধিমালা অনুযায়ী ‘ক্রয় প্রক্রিয়া পক্ষপাতহীন, অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং দরদাতাদের আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে দরপত্রে কারিগরি নির্দেশনায় এমন কোনো শর্ত সংযোজন করা যাবে না যা সরাসরি একটি প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিকে নির্দেশ করে’কিন্তু এই দরপত্রটি পণ্য সরবরাহের জন্য করা হলেও এখানে দরদাতার যোগ্যতায় ‘সরবরাহকারির কাছে ফ্যাক্টরিরর আপডেট লাইসেন্স থাকতে হবে, কৃষি বিপণন অধিদফতরের লাইসেন্স থাকতে হবে এবং পরিবেশ অধিদফতরের লাইসেন্স থাকতে হবে’ মর্মে ক্রয়ের সাথে অসমজস্যপূর্ণশর্ত জুড়ে দেয়া হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ছাইফুল আলম জানান, বিষয়গুলো তার জানা নেই। জানা যায়, এরপর ডিজি যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পিডি রবিউল ইসলামের কাছে অভিযোগগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা চান।এ বিষয়ে পিডিরবিউল ইসলাম বলেন,ডিজি মহোদয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে (রোববার দুপুর)। আসলে এখনো দরপত্রগুলোর ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়নি। তিনি আমাকে তার সাথে জরুরিভাবে দেখা করতে বলেছেন। তার অনুমতি সাপেক্ষে দরপত্র বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করবো।ঈদের ছুটির মধ্যে দরপত্র আহ্বান এবং জমা দেয়ার তারিখ নির্ধারণ অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেও দাবি করেন তিনি।