নিয়ন্ত্রিত হবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার এখতিয়ার - Alokitobarta
আজ : বৃহস্পতিবার, ২০শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিয়ন্ত্রিত হবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার এখতিয়ার


মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম: আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেই বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে ক্ষমা প্রদর্শনের। এছাড়া দেশের সব প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করতে সংবিধান সংশোধনসহ ২৮ বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।বুধবার কমিশনের প্রধান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর হস্তান্তর করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনেই এসব সুপারিশ উঠে আসে। এতে বিচার বিভাগসংশ্লিষ্ট সংবিধান সংশোধনীর বিষয় তুলে আনা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)-এ বলা হয়েছে ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কিনা এবং দিয়ে থাকলে কি পরামর্শ দিয়েছেন, কোনো আদালত সেই সম্পর্কে প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।’ এক্ষেত্রে কমিশন সুপারিশ করেছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সীমিত করে নিয়োগ কমিশনকে ক্ষমতায়িত করা। প্রতিবেদনে বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী বা দলের সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে মোবাইল কোর্টকে শুধু জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়। আরও বলা হয়, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন। পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য বিচারক নিয়োগে পৃথক কমিশন গঠন, জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা, উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠার সুপারিশও সংস্কার প্রস্তাবে আছে।

আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে ৩ অক্টোবর বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এরপর থেকেই কমিশন সরেজমিন বিভিন্ন আদালত পরিদর্শন, মতবিনিময়সহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করে। দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর কমিশন ৩০টি বিষয়ে আলোকপাত করে। ২৮টি বিষয় উল্লেখ করে সারসংক্ষেপ বুধবার প্রকাশ করা হয়। কমিশনের সদস্যরা হলেন-হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, মো. মাসদার হোসেন, সিনিয়র অ্যাডভোকেট তানিম হোসেইন শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসাইন।সংস্কার প্রস্তাবের সার সংক্ষেপে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারকের সংখ্যা নির্ধারণে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের প্রাধান্য এবং আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিধান প্রণয়ন করতে হবে। যথাসম্ভব স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের জন্য প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে ৯ (নয়) সদস্য বিশিষ্ট ‘সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ কমিশন’ গঠনের উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারক, সাবেক বিচারক এবং সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য পদ্ধতি ছাড়া অপসারণযোগ্য নন এমন পদে আসীন ব্যক্তিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ করা।

সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় : সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনক্রমে পৃথক সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় স্থাপন এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহি কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে এসবের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিমকোর্টের অধীনে আনা। সে উদ্দেশ্যে বিচার-কর্মবিভাগের সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয়ের আওতায় বিচার-কর্মবিভাগের বিচারক ও কর্মচারীদের পারিশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত করা।

আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ : সংস্কার প্রস্তাবের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজধানীর বাইরে প্রতিটি বিভাগীয় সদরে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা এমনভাবে বজায় রাখতে হবে, যেন বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা বিভাজিত না হয়। রাষ্ট্রের একক চরিত্র ক্ষুণ্ন না হয়। উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান, দূরত্ব ও মামলার চাপ বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত স্থাপন করা।

স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস : সুপ্রিমকোর্ট এবং অধস্তন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করা। ক্রান্তিকালীন বিধান রাখা যেন প্রস্তাবিত রূপরেখা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার আগে অ্যাটর্নি সার্ভিস কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।

বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ : সুপ্রিমকোর্ট ও অধস্তন সব পর্যায়ের বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দুর্নীতিবিরোধী সুস্পষ্ট বিধান সংবলিত আচরণবিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। প্রতি ৩ বছর পরপর সুপ্রিমকোর্ট এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির বিবরণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হবে।

মোবাইল কোর্ট : আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলার সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে মোবাইল কোর্টের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা সংশোধন করে শুধু জরিমানা প্রদানের বিধান করা হবে। বিভিন্ন আইনে বর্ণিত ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন।

মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ : মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ বিষয়ে একটি বাস্তবানুগ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারায় উল্লিখিত জরিমানা ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি : রাষ্ট্রে এমন অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়, যার বিচার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষিতই থাকে। এসব অপরাধের প্রতিকার না হওয়ায় অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। আইন মানার প্রতি সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের কোনো দায়িত্ববোধ জন্মে না। এই উদ্দেশ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০(১)(গ) ধারার অধীনে অপরাধ আমলে নেওয়ার সুবিধার্থে উক্ত বিধিতে প্রেসক্রাইবড ফরম সংযোজন করা।

বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ : বিচারাঙ্গনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার উদ্দেশ্যে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী বা অন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল কর্তৃক সব ধরনের সভা-সমাবেশ বা মিছিল নিষিদ্ধ করা। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা। বার সমিতি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিলোপ করা।

প্রতিক্রিয়া : প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগের বিষয়ে কমিশনের সুপারিশকে সমর্থন করেছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসও যুগোপযোগী বলে তিনি মনে করছেন। আদালতের রায়ে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশকে সমর্থন জানান। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালত দণ্ড প্রদান করার পর রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুপ করায় আদালতের আর কর্তৃত্ব থাকে না। বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করার পক্ষে মত দিয়েছেন আপিল বিভাগের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি বলেন, ‘সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। এর আগে অষ্টম সংশোধনীতে ছয়টি বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করা হয়েছিল; পরে সুপ্রিমকোর্ট তা বাতিল করেন। তবে মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করলে এটা করা দরকার। রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুপারিশকে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আদালতের রায় আছে। এ নিয়ে একটি গাইডলাইন করা যায়।

এসব ছাড়াও কমিশনের প্রস্তাবে আরও যে বিষয় সুপারিশ করেছে তা হলো-স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান-সংশোধনী, অধস্তন আদালতের সাংগঠনিক কাঠামো, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, বিচার কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অধস্তন আদালতের ভৌত অবকাঠামো, আদালত ব্যবস্থাপনা, বিচার প্রার্থীদের হয়রানি লাঘব, বিচার বিভাগে দুর্নীতি প্রতিরোধ, আইনগত সহায়তা কার্যক্রম, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, মামলা জট হ্রাস, গ্রাম আদালত, মোবাইল কোর্ট, আইনের সংস্কার, বিচারক ও সহায়ক জনবলের প্রশিক্ষণ, আইন পেশার সংস্কার, আইন শিক্ষার সংস্কার, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ।

Top