বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য



মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ভার জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশের সঙ্গে তারা যেমন একমত পোষণ করেছেন, তেমনি অনেক ইস্যুতে ভিন্নমতও প্রকাশ করেছেন। তবে একবাক্যে সবাই বলেছেন-সংবিধান এবং নির্বাচনব্যবস্থার পুরো খোলনলচে বদলের আগে এ নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনার বিষয় রয়েছে। আরও বিচার-বিশ্লেষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও খুবই জরুরি। কারণ দিন শেষে দেশ পরিচালিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই। বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চার সংস্কার কমিশনের প্রধানরা তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন এই কমিটির প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। নির্বাচনব্যবস্থাসংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেন কমিটির প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। এছাড়া পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারসংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেন এই দুই কমিটির প্রধান সফর রাজ হোসেন এবং ড. ইফতেখারুজ্জামান।পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর খুব একটা ভিন্নমত না থাকলেও আলোচনা চলছে সংবিধান এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে। বিদ্যমান সংবিধানের মূল নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন এনে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ এতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ প্রস্তাব করা হয়েছে। সংবিধানে বিদ্যমান ‘প্রজাতন্ত্র’ এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দেও পরিবর্তন এনে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি’ কমিশন এই বিধানটি বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে। তারা বর্তমান অনুচ্ছেদ ৬(২) সংশোধন করে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলে পরিচিত হবেন’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের জন্য বলেছে।
এছাড়া ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাসসহ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষে আসন থাকবে ৪০০। নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে, সরাসরি ভোটে। এর মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তারাও নির্বাচিত হবেন সরাসরি ভোটে। আর উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। এর মধ্যে ১০০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক পদ্ধতিতে। বাকি পাঁচটি আসনের সদস্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনো কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) মনোনীত করবেন। সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে মোট আসন হবে ৫০৫টি। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে ৪ বছর। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ ভাগ তরুণ-তরুণীর মধ্য থেকে মনোনীত করতে হবে। এজন্য জাতীয় সংসদে নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে সংবিধান এবং নির্বাচনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।যদিও বর্তমানে জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। আর সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ রয়েছে ২৫ বছর। একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে কোনো বয়স নির্ধারণ করা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, এসব সুপারিশ গ্রহণ করা হলে সংবিধান উলটো পথে যাত্রা করবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাহাত্তরের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ষোলোবার সংবিধানে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। যার বেশির ভাগই হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থে কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে। তাই সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে চাইলে কিংবা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে চাইলে সবার আগে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। পাশাপাশি সব শ্রেণি-পেশার মতামত নেওয়াটাও জরুরি।তিনি আরও বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। এটা কমিয়ে ৪ বছর করা হলে তা রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া সম্ভব নয়। একইভাবে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, এক ব্যক্তি দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা, প্রধানমন্ত্রী দলীয় পদে না থাকা, ডেপুটি স্পিকারের দুটি পদ সৃষ্টি, এদের একজন বিরোধী দল থেকে নির্বাচন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচন করা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ বেশকিছু সুপারিশ রয়েছে কমিশনের। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, নারী আসন ১০০ আসনে উন্নীত করা, এসব আসনে সরাসরি নির্বাচন, আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচনের মতো বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং ঐকমত্য প্রয়োজন।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সংস্কার কমিশন কী কী বিষয়ে সুপারিশ দিয়েছে তা আমরা এখনো হাতে পাইনি। সংবাদপত্রে দেখেছি, পড়েছি, তবে এর ওপর ভিত্তি করে কথা বলা ঠিক হবে না। পুরো সুপারিশ হাতে পেলে, এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে আমরা আমাদের মতামত জানাব। তিনি আরও বলেন, সুপারিশ যে যাই দিক না কেন এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এটি একটি প্রস্তাব। এর অনেক কিছুই ভালো আছে। কিন্তু এটি চূড়ান্ত নয়। সরকার আমাদের বলেছে, কমিশনের এসব প্রস্তাব নিয়ে তারা রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। তখন আমাদের মতামত দেব। যেহেতু চূড়ান্ত নয়, একটি খসড়া প্রস্তাব, সেই খসড়া প্রস্তারের ওপর আগাম মন্তব্য করাটা আমরা সমীচীন মনে করি না। আমাদের সঙ্গে বসা হবে, সেখানে আমাদের মতামত দেব।
তিনি আরও বলেন. সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে মতবিনিময় করবেন। ফলে এটা তো সরকারেরই প্রয়োজন। প্রস্তাব দিয়েছে তার অর্থ এই নয় যে, যা দিয়েছে হুবহু বাস্তবায়িত হবে। স্টেকহোল্ডার যারা তাদের সঙ্গে সরকার কথা বলবেন। আমরাও আলাদাভাবে আমাদের সংস্কার প্রস্তাব সরকারকে দিয়েছি। সেখানে আমরা অনেক কথা বলেছি। এখন চূড়ান্ত করার প্রয়োজনেই তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে আমরা জেনেছি। আমরা সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি।সংবিধান এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে দেওয়া সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড. কর্নেল অলি আহমদ বলেন, সংবিধান সংস্কারের জন্য যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনি একজন আমেরিকান নাগরিক। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে তিনি মোটেও অবগত নন। সুতরাং তাকে প্রধান করে যে দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে, তা সরকারের একটি ভুল পদক্ষেপ। তিনি বলেন, একজন আমেরিকান নাগরিককে দিয়ে এ দেশের মানুষের জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন মোটেও সম্ভব নয়।বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আরও বিশদভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের কিছু সুপারিশ আমাদের চাওয়ার সঙ্গে মিলে গেছে। আবার কিছু সুপারিশ পুরোপুরি উলটো, যা দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, অনেকেই অনেক রকম সুপারিশ করতে পারেন। এগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। বর্তমান সরকারের উচিত অহেতুক সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা। এজন্য যেখাকে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন তা করা।
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ আরও বলেন, আমরা দেখলাম বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এটা একটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব প্রস্তাব কোনোভাইবে গ্রহণযোগ্য নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাহাত্তরের সংবিধান বারবার ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। এটা ঠিক মূল সংবিধানে কিছুটা ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। তাই বলে এই সংবিধানকে কবর দেওয়ার প্রচেষ্টা ৩০ লাখ শহিদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে, যা আমরা কখনোই হতে দেব না। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ছাত্র-যুবকরা স্লোগান দিয়ে বলেছেন, ‘মুক্তিযুক্ত এনেছি, সংস্কার আনব’। এর অর্থ তারা মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার করেননি। এখন দেখছি সুপারিশের নামে কেউ কেউ মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সদস্য, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, চারটি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং পুলিশের সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে তার অনেকটাই আমাদের দীর্ঘদিনের চাওয়া। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে তা ইতোমধ্যে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ তাদের সুপারিশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে করে রাষ্ট্র ও সমাজে বৈষম্য এবং বিভাজন আরও বাড়বে। বাংলাদেশ গভীর খাদে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস, সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকাতে বা এক ব্যক্তির হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয়, সে জন্য ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, একজন সংসদ-সদস্য একই সঙ্গে নিম্নলিখিত যে কোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না, সংবিধানের বহুল আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া; প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা যাতে না হন, এমন বিধান; নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা; নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান; প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য; বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা-এসব দাবি আমাদেরও দীর্ঘদিনের। কিন্তু তাই বলে পুরো সংবিধানকে সংস্কারের নামে উলটো দিকে নিয়ে যাওয়াটাকে আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না, তাই তাদের সুপারিশ আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। সংবিধান সংস্কারের পাশাপাশি ফেরারি আসামিদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নির্বাচন করতে পারবেন না এবং কোনো দলের সদস্য হতে পারবেন না। বিদ্যমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নৈতিকস্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম ২ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায় না। এছাড়া ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে কোনো অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিও নির্বাচনের অযোগ্য। দুর্নীতির কারণে প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারিত ব্যক্তিও অযোগ্য। অনেকে উচ্চ আদালতে আপিল করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকেন। কমিশনের সুপারিশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুরুতর দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের দায়ে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনের অযোগ্য করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও তারা তরুণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১০ শতাংশ মনোনয়নের সুযোগ তৈরির বিধান করা; স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধানের পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির বিধান করা, না ভোটের বিধান, প্রবাসীদের ভোটাধিকার, এক ব্যক্তির একাধিক আসনে প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিল করা, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা তথ্য গোপনের কারণে নির্বাচিত ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) শক্তিশালী করার জন্য একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছে। ওই আইন বা এর বিকল্প হিসাবে একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা যেতে পারে বলে কমিশন মত দিয়েছে। সংস্কার কমিশন মনে করে, ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালের মতো বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া যেতে পারে। তবে নির্বাচন স্থগিত করা যাবে শুধু সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলো চার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ইতোমধ্যে নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা করেছে। নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্র্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে কম-বেশি সবাই একমত পোষণ করেছেন। তবে বিপত্তি দেখা দিয়েছে সংবিধান এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে। বর্তমান সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ এর আমূল সংস্কারের জন্য সাত ভাগে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে এ সংক্রান্ত কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। যা বাস্তবায়নে আরও সময় নেওয়া প্রয়োজন। আলাপ-আলোচনা এবং ঐকমত্য প্রয়োজন।এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, যেহেতু সংস্কার কমিশন আমাদের কাছ থেকে কোনো মতামত নেয়নি, তাই এ বিষয়ে কোনো মতামত দেব না। তবে তাদের সুপারিশ দেখে এ বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজন বোধ করলে আমরা অবশ্যই আমাদের বক্তব্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরব।জানতে চাইলে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এ প্রসঙ্গে বলেন, সংস্কার কমিশন আমাদের কাছে প্রস্তাব চেয়েছিল। আমরা দিয়েছি। তারা আমাদের অনেক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এজন্য আমরা মোটাদাগে তাদের সুপারিশ সমর্থন করছি। তবে এসব সুপারিশ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে বসে ঠিক করবে।বিএনপির সমমনা ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে পাইনি। আমরা এগুলো হাতে পাওয়ার পর দলীয় ফোরামে এবং জোটের শরিকদের মধ্যে বসে এ বিষয়ে মন্তব্য করব। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরাখবর দেখে আমাদের মনে হয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের সঙ্গে আমাদের চাওয়া-পাওয়া মিলছে না। তারা অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় যেমন সংযুক্ত করেছেন। আবার অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় এড়িয়ে গেছেন।