ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিককালের নৈরাজ্যকর বিক্ষোভে উদ্বেগ প্রকাশ
মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিককালের নৈরাজ্যকর বিক্ষোভে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির দাবি, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারা মনে করেন, সরকার এই বিক্ষোভ সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত আমলে নিয়ে সরকার চালালে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতাদের আলোচনায় এই ধরনের পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এমন প্রেক্ষিতে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা এবং পরিস্থিতি উত্তরণে কী করা উচিত সে বিষয়ে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের কিছু পরামর্শ তুলে ধরবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সাম্প্রতিকালের নৈরাজ্যের বিষয়ে বিএনপির বিশ্লেষণ হচ্ছে, সরকার শুরু থেকে নৈরাজ্যের বিষয়ে কঠোর ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের নমনীয়তা বর্তমান নৈরাজ্যের অন্যতম কারণ। এ ধরনের চক্রান্ত ও সহিংস অবস্থা তৈরি হতে পারে এমন শঙ্কা থাকার পরও সরকার শক্ত হাতে দমন করেনি। ফলে এখন একটি বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছে।
তাদের আরও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার তা সেভাবে আমলে নেয়নি। প্রশাসনে এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা ‘শক্ত’ অবস্থানে আছে। নেতাদের মতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসরদের’ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে রাখলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে তা নিয়ে বারবার সতর্ক করা হয়েছিল। স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে কমিটির কোনো নেতা নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নেতা বলেন, সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কারে মনোনিবেশ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলে পরিস্থিতি এ রকম হতো না। নির্বাচন দিতে যত দেরি হবে এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ততই বাড়বে।বৈঠক সূত্র জানায়, আলোচনার শুরুতে সংবিধান সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্থায়ী কমিটির এক নেতা। প্রস্তাব পাশ করতে চাইলে কমিটির দুজন সিনিয়র সদস্য আপত্তি জানান। তারা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে তারপর পাশ করার পরামর্শ দেন। এ নিয়ে বিতর্কে জড়ান তিন নেতা। পরে অবশ্য কিছু আলোচনার পর কয়েকটি বিষয়ে সংশোধনী এনে প্রস্তাব পাশ করা হয়।
উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ সংবিধান সংস্কারে ৬২ প্রস্তাব : সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্ববাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। মঙ্গলবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নিজেদের লিখিত প্রস্তাব জমা দেয় দলটি। পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে তফশিল পর্যন্ত ৬২টি জায়গায় বিভিন্ন সংশোধনীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনার মূল অংশে কিছু নতুন প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহিদের রক্তের অঙ্গীকার, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যাতে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি না হয়, সেগুলো মাথায় রেখে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, একই ব্যক্তি পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এমন বিধান; সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ যাতে সুপ্রিমকোর্টের অধীনে থাকে, গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিএনপি নেতা বলেন, প্রস্তাবনায় প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, তফশিলসহ সব বিষয় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে সংবিধানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাধিত হয়। রাষ্ট্রের সব অঙ্গে যাতে সব ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, সেই প্রস্তাবও রয়েছে। সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপি কোনো বক্তব্য দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ব্যাপকভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন তারা, যাতে এটা গণতান্ত্রিক সংবিধান সংশোধন হয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়।
সংসদ না থাকায় সংবিধান সংশোধন কীভাবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, বিশেষজ্ঞসহ সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারা চূড়ান্ত করবেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবাই একমত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকতেই পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে, সেগুলো তারা যদি অঙ্গীকার করেন, নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিফলন করেন, তাহলে সবার অঙ্গীকার থাকবে পরবর্তী নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা সংবিধান সেভাবে পরিবর্তন করবেন।