গায়ের জোরে একতরফা নির্বাচনে তিনি বিশ্বাসী নন
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: প্রয়োজনীয় (অ্যাসেন্সিয়াল) সংস্কারের পর নির্বাচন আয়োজন করবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাই এখনই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা জানাতে চাননি নতুন সিইসি। জাতীয় সংসদ নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হবে সেই বিষয়েও প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি। তবে তিনি জানান, গায়ের জোরে একতরফা নির্বাচনে তিনি বিশ্বাসী নন। স্বচ্ছ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে তার নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন। রোববার শপথ নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গিয়ে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এ সময় তার পাশে চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বেলা দেড়টায় সুপ্রিমকোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সিইসি ও চার কমিশনারকে শপথবাক্য পাঠ করান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। শপথ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। এ সময় নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম, সুপ্রিমকোর্টের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শপথ গ্রহণের জন্য বেলা সোয়া ১২টার পর তারা সুপ্রিমকোর্টে আসেন। শপথের পর সিইসি ও চার কমিশনার নির্বাচন ভবনে যান। তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানান ইসি কর্মকর্তারা। এদিন বিকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন সিইসি। ওই মতবিনিময় শুরুর আগে কনফারেন্স রুম থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলা হয়। মতবিনিময়ের পর তারা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে যান। সেখানে রাত পর্যন্ত অবস্থান করেন সিইসি ও চার কমিশনার।
সিইসি আরও জানান, নির্বাচনের এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান, যে পরিবেশে ভোটাররা তাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। এজন্য যা যা করণীয় তা করবেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে শতভাগ নিরপেক্ষ ভোট করার। আগে ডামি-আমি নির্বাচন হয়েছে। ১৫৩ জন ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়েছে। ওইসব যাতে না হয় সেজন্য আল্লাহতায়ালা আমাদের পাঠিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিয়ে বিতর্ক আছে, জাতীয়ভাবে ওই বিতর্কের ফয়সালা হওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
গত বৃহস্পতিবার এএমএম মো. নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিশন নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। বাকি চার কমিশনার হলেন- সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্মসচিব তহমিদা আহমদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করে। ৭৯ দিন শূন্য থাকার পর গতকাল নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করল।
ইসিতে মতবিনিময়ে নির্বাচন কবে হবে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দীন বলেন, দিনক্ষণ বলতে পারব না। যে কোনো নির্বাচন করতে গেলে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ থাকে। কিছু অ্যাসেন্সিয়াল সংস্কার তো করতেই হবে। উদাহরণস্বরূপ যেই তরুণ প্রজন্ম ভোটের অধিকারের জন্য এত ত্যাগ করল, তাদের ভোটাধিকারের সুযোগ দিতে হলে ভোটার করতে হবে। শুনতে পাই ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা ও অনেক ফেইক ভোটার আছে। সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। আবার কেউ কেউ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হোক, আবার কেউ বলছে বিদ্যমান পদ্ধতি থাকুক। কেউ বলছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হোক, কেউ বলছে বর্তমান পদ্ধতি বহাল থাকুক। যেটাই হোক না কেন, সেই অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই ধরনের জিনিসগুলোর ফয়সালা না হলে আমরা কীভাবে ভোট করব? তিনি বলেন, সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করে দিয়েছে। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন থেকে যেসব সুপারিশ আসবে, সেখান থেকে সবার কাছে যেসব সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে সেগুলো আমরা নেব। ওইসব সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করার পর যখন নির্বাচন আয়োজন করার মতো সবকিছু রেডি হবে তখনই আমরা ইনশাআল্লাহ নির্বাচনের তারিখ দেওয়ার মতো চিন্তাভাবনা করতে পারব। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন কাজ করছে। তাদের সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন কীভাবে করব-প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দল অংশ নিতে পারবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেক দলের ভোটের অধিকার থাকবে। সংস্কার কমিশনগুলো নিশ্চয়ই এসব বিষয়ে সুপারিশ দেবে। তাদের সুপারিশের পর তা বিবেচনা করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যেই সিদ্ধান্ত আসবে, সেটাই হবে। আর বড় দল আওয়ামী লীগ ও জোটের শরিকদের নিয়ে সিরিয়াস বিতর্ক আছে। এসব বিতর্কের ফয়সালা আগে হোক। ভোট তো দেরি আছে। কাল-পরশু তো ভোট হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে জাতীয়ভাবে ফয়সালা হোক। সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।
বিগত তিন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করবেন না বলে জানান নবনিযুক্ত সিইসি। তিনি বলেন, মানুষ এখন ভোটের নাম শুনলে নাক সিটকায়। প্রশ্ন তোলে ভোট দিলে কী হবে? কেউ কেউ বলেন, ভোট রাতে হয়ে গেছে। সরি টু সে- কেউ কেউ বলেন কুত্তা মার্কা নির্বাচন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জ একটাই তা হলো জাতিকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। এটাকেই আমরা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি। এটাই আমরা মোকাবিলা করতে চাই। এক প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দীন বলেন, আমরা একতরফা নির্বাচনে বিশ্বাস করি না। বুঝতেই তো পারছেন একতরফা নির্বাচনের কারণে দেশের ১২টা বেড়ে গেছে। গায়ের জোরে ইলেকশন করতে গেলে সেটাই তো হয়েছে। আমরা কোনো গায়ের জোরের নির্বাচন দেখতে চাই না। কোনো একতরফা নির্বাচন আমরা দেখতে চাই না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ফিল করছি শেষ জীবনে আল্লাহতায়ালা আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছেন। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা করি। আমরা যদি ফেল করি তাহলে এ দেশের ভোটিং সিস্টেমের অবস্থা কী হবে তা বুঝতে পারছেন।
সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করতে পারবেন কী-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সরকার সেই সরকার নয়, যেই সরকার চাপ দেয়। আগের সরকার চাপ দিয়েছে কারণ তাদের দলীয় এজেন্ডা ছিল। অন্তর্বর্তী এই সরকারের কোনো দলীয় এজেন্ডা নেই। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ নেই। ফ্রি, ফেয়ার ইলেকশন দিয়ে রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে উনি মুক্তি পেতে চান। উনার সরকারের তরফ থেকে কোনো চাপ নেই। অতীতে সরকারের তরফ থেকে নির্বাচন কমিশনের ওপর যে চাপ ছিল, ওইটাই বড় চাপ ছিল। আমি বিশ্বাস করি, কোনো চাপ থাকবে না। আমাদের স্বাধীনতা দেওয়া আছে।
এদিকে শপথ নেওয়ার পর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সিইসি বলেন, শপথ নিয়েছি, শপথের সম্মান রাখতে চাই। শপথ সমুন্নত রাখতে চাই। তিনি বলেন, দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। বিগত বছরগুলোতে তারা ফ্রি ও ফেয়ার নির্বাচনের জন্য অনেক সংগ্রাম করেছে, অনেক আন্দোলন করেছে, অনেক রক্ত দিয়েছে। আমি তাদের অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এজন্য আমি আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, আপনারা আশ্বস্ত থাকুন, আমাদের নিয়ত সহীহ। আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারি ভালো নির্বাচন হবে। এজন্য ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে যেসব রাজনৈতিক দল ভোটাধিকার চেয়ে আসছে তাদের সহযোগিতা পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে ইসির চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার চাকরি জীবনে এমন অনেক বিশেষ পরিস্থিতি এসেছে। আমি তিন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। সাকসেসফুলি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস ও অভিজ্ঞতা আমার আছে। যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ আসুক, সবাইকে নিয়ে ওভারকাম করব ইনশাআল্লাহ। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বিতর্কের ফয়সালা হোক, তখন দেখতে পারবেন।
নামিয়ে ফেলা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি : জানা গেছে, নতুন কমিশনের আগমন উপলক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের কনফারেন্স রুম থেকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলা হয়। এর আগে সিইসি ও চার কমিশনারের রুম সংস্কারের সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানো হয়। গতকাল পর্যন্ত ওই ছবি দেওয়ালে সাঁটানো হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির কর্মকর্তারা জানান, নতুন কমিশনের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। তারা অনুমতি দিলে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সাঁটানো হবে।