২৪ সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ
মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম : হাসিনা সরকারের আমলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত অভিযোগে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাসহ ২৪ জনের পাসপোর্ট বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এতে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ের প্রতাপশালী প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। যাদের বেশিরভাগ আলোচিত ‘আয়নাঘর’-এর কারিগর হিসেবে অভিযুক্ত। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠানো চিঠিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর এ সিদ্ধান্তের কথা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে পাসপোর্ট অধিদফতর। যদিও এর আগেই বেশিরভাগ কর্মকর্তা বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে মোট ২২ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮ নবেম্বর পাসপোর্ট অধিদফতরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির প্রাথমিক তদন্তে ঐ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। তদন্তের প্রয়োজনে বর্ণিত ব্যক্তিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে তাদের পাসপোর্ট বাতিলসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। পাসপোর্ট বাতিলের জন্য পাঠানো তালিকার বেশিরভাগ কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের সময় সামরিক বাহিনীতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কয়েকজন ছিলেন ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রধান। বাকিরা চাকরি জীবনে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাসপোর্ট বাতিলের জন্য পাঠানো তালিকার এক নম্বরে রয়েছে লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবরের নাম। তিনি হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ২২ জুন পর্যন্ত যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের (টিএফআই) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া তালিকায় আছেন লে. জেনারেল আকবর হোসেন, সাইফুল আবেদীন, সাইফুল আলম, আহমেদ তাবরেজ শামশ চৌধুরী, মেজর জেনারেল হামিদুল হক। যারা বিভিন্ন সময়ে ডিজিএফআই ও এনএসআই’র শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের বিরুদ্ধে আলোচিত আয়নাঘর সৃষ্টি, গুম ও ক্রসফায়ারে রাজনৈতিক বিরোধী নেতাকর্মী দমনসহ গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তালিকায় আরও রয়েছে-মেজর জেনারেল শেখ মামুন খালেদ, মেজর জেনারেল সুলতানউজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন, মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, মেজর জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেইন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তানভির গনি চৌধুরি, কর্নেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সাবেরী খান, সাবেক র্যাব কর্মকর্তা কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন, লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ, লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ, লে. কর্নেল মেহেদী হাসান, মেজর রাহাত উস সাত্তার, ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া উর রহমান ও ওয়ারেন্ট অফিসার ইমরুল কায়েসের নাম। এছাড়া, ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা সাবেক পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিনের পাসপোর্টও বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুজনেই চাকরি জীবনের একটি বড় সময় র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে সংযুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে আলেপ উদ্দিন র্যাব-১১তে কর্মরত থাকাকালে তার বিরুদ্ধে গুম ও ক্রসফায়ারে একাধিক অভিযোগ ওঠে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গুম কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, বর্ণিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৯ জন ডিজিএফআই’র অভ্যন্তরে অবস্থিত বিশেষ যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেল বা জেআইসি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলের বিভিন্ন সময়ে তারা সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া, ডিজিএফআই’র সাবেক প্রধান লে. জেনারেল সাইফুল আলম, লে. জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল হামিদুল হককে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, ডিজিএফআই’র অভ্যন্তরে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) নামক শাখায় দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন সময়ে র্যাবে সংযুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে লে. জেনারেল এস এম মতিউর রহমান ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি), কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন র্যাব গোয়েন্দা শাখার উপপরিচালক, র্যাব-১ এর অধিনায়ক ও এডিজি ছিলেন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন ছিলেন সিটিআইবি’র কর্নেল জিএস। বর্তমানে তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে পালনোর চেষ্টা করছেন বলে জানতে পেরেছে গুম কমিশন। এর বাইরে পাসপোর্ট বাতিলের তালিকায় থাকা কর্নেল মোহাম্মদ কামারউজ্জামান সাবেরী খান ডিজিএফআই সদর দফতরের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। পাসপোর্ট বাতিলের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গুম কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, অত্র কমিশনের কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার নিমিত্তে তদন্ত চলাকালে উক্ত ব্যক্তিদের দেশত্যাগে বিরত রাখার জন্য তাদের পাসপোর্ট বাতিল করে সকল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে অবগত করাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক। তাই আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ কমিশনকে অবগত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, গত ৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টাম-লীদের সভায় বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আংশিক তালিকা সংযুক্ত করে পত্র পাঠানো হলো।