কারাগারে ওরা ‘জামাই আদরে’আওয়ামী লীগের বন্দি নেতারা টাকা উড়াচ্ছেন
মোহাম্মাদ মুরাদ হোসেন: শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মতোই লুটপাটের টাকায় কারাগারে থেকেও বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর সাবেক মন্ত্রী, সাবেক এমপি, সাবেক সচিব, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা। ডিভিশনের সুবিধা নিয়ে জামাই আদরেই কাটছে তাদের বন্দিজীবন। রয়েছে ব্যক্তিগত সহকারী (কাজের লোক)। কারো কারো কক্ষে রয়েছে ফ্রিজ। ইচ্ছেমতো রান্না করিয়ে খাচ্ছেন। বিনোদনের জন্য রয়েছে টেলিভিশন। নিয়মিত পড়ছেন পত্রিকা। একজন অন্যজনের রুমে গিয়ে আড্ডাও জমাচ্ছেন বেশ। মোবাইল ফোনে নির্দেশনা দিচ্ছেন দলীয় নেতা-কর্মীদের। কারো কারো বিশ্বাস অচিরেই ফিরে আসবেন পুরনো বেশে। কেউ কেউ অসুস্থতার বাহানায় কাটাচ্ছেন হাসপাতালে। কারাগারের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তাদের জামাই আদরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ঢাকায় ৬০ জনসহ সারাদেশের কারাগারগুলোতে আ’লীগের সুবিধাভোগী শতাধিক ভিআইপি বা বিশেষ বন্দি রয়েছে বলে জানা গেছে।গত ৫ আগস্ট আ’লীগ সরকারের পতনে শেখ হাসিনার মতোই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন দলটির নেতা, মন্ত্রী-এমপি ও অনেক প্রভাবশালী। যারা ধরা পড়েছেন তাদের রিমান্ডে থাকতে হয়েছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাস্টডিতে। অভিযোগ রয়েছে, রিমান্ডেও টাকার জোরে আরামেই ছিলেন তারা। রিমান্ড শেষে কারাগারেও এসব দোসর টাকার জোরে নিয়ন্ত্রণ করছেন সবকিছু। প্রবাদে রয়েছে ‘কারাগারে টাকা হলে বাঘের চোখ মেলে’। এরা টাকা উড়াচ্ছেন কারাগারে। ভিআইপি বন্দির নামে কর্র্তৃপক্ষ এদের জামাই আদরে রেখেছেন।
ফ্যসিস্ট আ’লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার দাপটে অনেক অপকর্ম করেছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্র্মকর্তারা। হাসিনা পালানোর পর এদের সবার বিরুদ্ধে কয়েকটি করে হত্যা মামলা হয়েছে। এরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ দিয়ে মানুষ হত্যায় প্ররোচনা দিয়েছেন। এদের অনেকেই গ্রেফতার হয়ে এখন বন্দি দেশের বিভিন্ন কারাগারে। তবে বেশিরভাগের ঠাঁই হয়েছে কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগারে।জানতে চাইলে সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (এআইজি-উন্নয়ন) মো. ফরহাদ গতকাল বলেন, আ’লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলাসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৬০ জন ভিআইপি বন্দি রয়েছেন কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগারে। এদের মধ্যে ৪৫ জনই পেয়েছেন প্রথম শ্রেণির ডিভিশন। এদের মধ্যে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনিসহ ৩ জন বিশেষ নারী বন্দিও রয়েছেন।
কারা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেসব ডিভিশনপ্রাপ্ত বিশেষ বন্দি আছেন তারা হলেনÑ দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামছুল হক টুকু, সাবেক উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, সাবেক সংসদ সদস্য আহম্মেদ হোসাইন, সাবেক রিয়াল অ্যাডমিরাল এম সোহাইল, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সোবহান গোলাপ, হাজী মো. সেলিম, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক সংসদ সদস্য শাহে আলম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমাম, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, কুষ্টিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জজ, ডিআইজি মিজানুর রহমান, পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান। ৫ আগস্টের আগে গ্রেফতার সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও পেয়েছেন ডিভিশন। মন্ত্রী না হয়েও অনেকের মিলেছে এ সুবিধা।
কারা সূত্র জানায়, জেল কোড অনুসারে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়। এছাড়া আদালতের নির্দেশেও কেউ কেউ ডিভিশন পান। তিন শ্রেণির ডিভিশনপ্রাপ্তদের আলাদা রুম বা সেলে রাখা হয়। যেখানে থাকে খাট, ভালো বিছানা, টেবিল, চেয়ার, তোষক, বালিশ, তেল, চিরুনি, আয়নাসহ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। বন্দিদের জন্য একজন করে সহকারী দেওয়া হয়। ছেলে বন্দির ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসেবে ছেলে আর মেয়ে বন্দির জন্য একজন মেয়ে থাকবেন। বন্দির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বইপত্র এবং দু-তিনটি দৈনিক পত্রিকা পাবেন। তবে কারাগার থেকে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত হাজতিরা জানিয়েছেন, জেল কোডের বাইরেও গণআন্দোলনের পর গ্রেফতারকৃত কথিত ভিআইপি বন্দিরা টাকার জোরে সকল ধরনের সুবিধাই ভোগ করছেন। একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে তাদের রাজার হালে থাকার সুযোগ করে দেন।
সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মো. ফরহাদ জানান, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১৫ দিনে একবার স্বজনরা দেখা করেন। এখনও পর্যন্ত সকল বন্দির সাথেই তাদের স্বজনরা দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। ভিআইপি এসব বন্দির কেউ বাইরের কিংবা কারা হাসপাতালেও ভর্তি নেই। যাতে করে স্পষ্টই বলা যায় ভিআইপি বন্দিরা ভালো ও সুস্থই রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা বলেন, কারাগার থেকে আদালতে নেওয়ার সময় কয়েকজন ভিআইপি বন্দি জনরোষের শিকার হয়েছেন। কারাগারের ভেতরেও তারা হাজতি কিংবা কয়েদিদের মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারেন এ বিবেচনায় নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকটি পৃথক কক্ষে ভাগ করে তাদের রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্তরা সুবিধা পাচ্ছেন। তবে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমরা এখন এদের জন্য বাইরের খাবার অ্যালাউ করছি না। নিয়মের বাইরে স্বজনদের সাথেও দেখা করার অনুমোদন দিচ্ছি না। সব বন্দির জন্যই স্বচ্ছতার সাথে নিয়মের মধ্যে যা হবার তাই হবে।
আমাদের রাজশাহী প্রতিনিধি জানান, রাজশাহীর আতঙ্ক সাবেক মন্ত্রী, মেয়র, এমপি আর তাদের ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে তিনজন ঢাকায় আর একজন নওগাঁয় ধরা পড়েছে। বাকিরা এখনো অধরা। ঢাকায় ধরা পড়া তিনজন হলেন বাগমারার সাবেক দুই এমপি এনা গ্রুপের মালিক ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক আর সর্বগ্রাসী আবুল কালাম আজাদ এবং মাত্র কয়েক মাস এমপির স্বাদ পাওয়া আসাদুজ্জামান আসাদ। নওগাঁয় ধরা পড়েছে জিরো থেকে হিরো হওয়া নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। আর দু’হাতে গুলি চালানো ক্যাডার রুবেল আর সবুজ। তাদের ঠিকানা এখন রয়েছে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার। এনামুল কারাগারে অন্য বন্দিদের হামলায় আক্রান্ত হলে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়ে এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন কারা হাসপাতালে। ডাবলু সরকার কোর্ট চত্বরে পচা ডিম, ঢিল আর কাদায় অভিসিক্ত হয়ে এখন রিমান্ডে। অন্যরা রয়েছেন বন্দি সেলে। নামে-বেনামে ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক এনামুলের বিরুদ্ধে রয়েছে নারী কেলেঙ্কারিরও অভিযোগ। এমপি আবুল কালাম আজাদ এমপি ও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাগমারায় কায়েম করেন ত্রাসের রাজত্ব। সশস্ত্র গ্যাংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বিআরটিসি বাসের টিকিট মাষ্টার ডাবলু সরকার রাজশাহী রুটের সমস্ত বিআরটিসি বাসের নিয়ন্ত্রকও ছিলেন। দলীয় প্রভাবে টেন্ডার বাণিজ্য, সংখ্যালঘুদের জমি দখল, বস্তিবাসীদের জমি দখল, জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই অন্তত ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেন। জেল থেকে সদ্য ছাড়া পাওয়া দু’জন বলেন, ওরা লুটপাটের টাকায় কারাগারেও আরাম আয়েশে রয়েছেন।
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, কারাগারে রাজার হালেই দিন কাটছে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিজিবির হাতে ধরা পড়া রাউজানের ফেরাউন খ্যাত কুখ্যাত খুনি দুর্নীতিবাজ সাবেক এমপি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী জুনু ওরফে জুইন্নার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় জনরোষ থেকে বাঁচতে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। এখন তিনি কারাগারে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। জুনুর আগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান বন্দর পতেঙ্গা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ। তাকেও ডিভিশন সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তিনি কারাগারে টয়লেটে আছাড় খেয়ে পড়ে কপালে আঘাত পান। দ্রুত তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দুইজন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বেশ কয়েক ক্যাডার গ্রেফতার হন। কোটাবিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে দিবালোকে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণকারী এসব খুনি চক্রের সদস্যদেরও জামাই আদরে রাখা হয়েছে কারাগারে। তারা দু’হাতে টাকা ছড়িয়ে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।