ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘এক মঞ্চে’ আনার চেষ্টা
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘এক মঞ্চে’ আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ‘নির্বাচনি ঐক্য’ গড়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ার চিন্তা করছে দলটি। ইতোমধ্যে অন্তত ছয়টি ইসলামি দল এবং আলেমদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে। আলোচনা হয়েছে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে। মূলত অন্তর্র্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর বিএনপির দলীয় অবস্থান কী হবে- তার ওপর নির্ভর করছে এই ঐক্যের চূড়ান্ত রূপ।এছাড়া ঐক্য গঠনে দলগুলো প্রাথমিকভাবে একমত হলেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে জোটের নেতৃত্ব কে দেবে-জামায়াতে ইসলামী নাকি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। পাশাপাশি ঐক্য গড়ার আগে কয়েকটি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আ’লা মওদূদীর ধর্মীয় বিষয়ে কিছু লেখা বা বক্তব্য নিয়ে আলেমদের সঙ্গে যে বিরোধ, তার সমাধান করার কথা জানিয়েছেন। তা না হলে একটি বড় ইসলামি দলসহ কয়েকটি দল ঐক্যে না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর পালটে যায় দেশের রাজনীতির চিত্র। প্রায় ১৬ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে দলটি রাজনৈতিক, সামাজিক, কূটনৈতিক ও সাংগঠনিকসহ নানা তৎপরতায় ব্যস্ত সময় পার করছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে ‘ফেরারি’ অবস্থান থেকে হঠাৎ করে রাজনীতির সম্মুখ ভাগে আসা জামায়াতকে নিয়ে অনেকের মধ্যে নানা আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ, সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়। যদিও এখন আবারও দুই দলই নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলছে। বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেড় সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, আওয়ামী লীগ এখন মাঠে নেই। দলটির (আওয়ামী লীগ) সভাপতিসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে বিচারকাজ শেষ হতে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সেজন্য বিএনপি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। এমনটা হলে এবং মাওলানা মওদূদীর কিছু লেখা বা বক্তব্য নিয়ে আলেমদের বিরোধের সমাধান হলে ‘নির্বাচনি ঐক্য’ চূড়ান্ত রূপ লাভ করতে পারে।জানতে চাইলে সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ঐক্য গঠনের বিষয়ে আমাদের আগ্রহের কথা আগেই বলেছি, আমাদের আমিরও বলেছেন। এ নিয়ে ইসলামি দলগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। জোট করতে গেলে কিছু মতপার্থক্য থাকে। এখন কোন দল কতটা উদার হবে, কতটা ছাড় দেবে; আলোচনা করে সবার পরামর্শের ভিত্তিতে এই ঐক্য গঠন করতে হবে।ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ঐক্য নিয়ে আলোচনা চলমান। এর লক্ষ্য হলো ইসলামি শক্তিগুলোকে এক জায়গায় আনা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষেরও একটা আগ্রহ আছে। কারণ তারা তো বিভিন্ন দলের ভূমিকা দেখছেন, অনেকটা হতাশ হয়েছেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া আছে, ইসলামি শক্তি এক জায়গায় এলে তারা সুখে থাকবে। আমাদেরও ইচ্ছা বিছিন্ন-বিক্ষিপ্ত না থেকে সবাই যদি এক জায়গায় হওয়া যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচনা আছে। কেউ কেউ বলছেন জামায়াতে ইসলামী বাদে যারা কওমি উলামায়ে কেরাম আছেন, কওমি ধারার তারা এক জায়গায় এলে পরে তাদের (জামায়াত) বিষয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আবার কারও কারও দৃষ্টিভঙ্গি-একেবারে জামায়াতসহ কেউ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় না থেকে এক জায়গায় হওয়ার। আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। এটি ধাপে ধাপে এগুচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। নির্বাচনের কাছাকাছি গেলে চূড়ান্ত অবস্থায় রূপ দেওয়া যাবে।
জানা গেছে, জামায়াত ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে। এর মধ্যে চরমোনাই পিরের ইসলামী আন্দোলন, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেন।এসব মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একাধিক দলের নেতা জানিয়েছেন, ইসলামপন্থিদের মধ্যে একটি ঐক্য চায় জামায়াত, বিশেষ করে নির্বাচনি ঐক্য। এ লক্ষ্যে জামায়াত ইতোমধ্যে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একটি যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বিরোধ বা বিতর্ক, সেটি কমেছে। এখন নির্বাচনি ঐক্য হলে ভালো, না হলেও জামায়াত তাতে খুব সমস্যা দেখছে না। তবে জামায়াত নেতারা মনে করছেন, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি ঐক্য হবে কিনা, সেটি নির্ভর করছে চরমোনাই পিরের দল ইসলামী আন্দোলনের ওপর। জামায়াতের পর ইসলামপন্থিদের সমর্থনের দিক থেকে এই দলটিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়।
আবার কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও সংগঠনটির নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মীর ইদরিস বলেন, হেফাজত রাজনৈতিকভাবে কোনো দল নয়। এ সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আছেন। তারা যদি ঐক্য করেন বাধাও নেই, আপত্তিও নেই। তবে ঐক্যের বিষয়টি আলাপ আলোচনার পর্যায়ে আছে। চূড়ান্ত কিছু হয়নি।তিনি বলেন, যে কারণে জামায়াতের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তা হচ্ছে মাওলানা মওদূদীর কিছু বিষয় নিয়ে উলামায়ে কেরামের আপত্তি। এখন তারা (জামায়াত নেতারা) যদি বলেন যে, মাওলানা মওদূদীর অনেক বিষয় ভালো আছে, ভালো বিষয় গ্রহণ করব আর যেগুলো নিয়ে উলামায়ে কেরামের আপত্তি আছে সেগুলো বিশ্বাস ত্যাগ করব। সে ঘোষণা দিলে তো কোনো আপত্তি থাকবে না।খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, নির্বাচনি ঐক্য মানে একটি আসনে একজন করে প্রার্থী থাকবে। সেটা নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করছি। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বসেছিলাম। নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো নিজেদের একাধিক প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই না করা-এটাই আমরা চেষ্টা করছি।জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), মুসলীম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিস (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। সমমনা ইসলামি দলের একজন নেতা জানান, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয় আছে। তারা জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনি ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে।