গার্মেন্টস পল্লীতে নজরদারীর তাগিদ
মহাব্বাতুল্লাহ:কারখানার ভেতরে ভাঙচুর, শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পক্ষে-বিপক্ষে হেনস্তা থেকে রাজপথের আন্দোলন তাদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হবে মনে করলেও তা পুরোপুরি শেষ হয়নি। হঠাৎ হঠাৎ করে উৎপাদন বন্ধ করে শ্রমিকদের উস্কে রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এতে করে নতুন করে চিন্তায় মালিকপক্ষ। শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাছেও এ পরিস্থিতি বেশ ধোঁয়াটে। ১৮ দফা মেনে নেওয়ার পরও কেন আন্দোলন থামছে না, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, ১৮ দফা মেনে নিলেও তা বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা, সেই চিন্তা দূর না হতেই দীর্ঘসময় কারখানা বন্ধের যে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে, সেটার চিন্তাও ভর করেছে। দ্রæত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না হলে সামনে দুর্ভোগে পড়তে হবে বলেও শঙ্কা তাদের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকার কঠোর হলে পরিস্থিতি এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ ক্ষেত্রে কারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, কারা শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে পথে নামাচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা নজরদারী বাড়াতে হবে। গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী তৎপর হলে শ্রমিকদের ষড়যন্ত্রকারীরা রাস্তায় নামাতে পারবে না। একই সঙ্গে যে সব মালিক বেতন না দিয়ে শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কারণে গার্মেন্টস পল্লীতে শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে।গত বুধবার ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের টানা ৫২ ঘণ্টার অবরোধ প্রত্যাহার করেছেন শ্রমিকরা। ওইদিন দুপুর ১টার দিকে পুলিশের আশ্বাসে তারা সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। বকেয়া পাওনা পরিশোধের দাবিতে গত সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ওই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি অবরোধ করে রাখেন বার্ডস গ্রæপের শ্রমিকরা। আশুলিয়া থানার ওসি আবু বক্কর জানান, শ্রমিকদের বুঝিয়ে এবং মালিকপক্ষকে তাদের মুখোমুখি করার আশ্বাস দিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।এদিকে, গত বুধবার নতুন করে ১০টি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পুনর্বহাল এবং পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের দাবিতে গাজীপুরে পোশাক শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। সকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগরা এলাকায় তারা বিক্ষোভ শুরু করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। বিশৃংখলা এড়াতে আশপাশের ১০টি কারখানা আজকের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
গত ১৫ দিন ধরে যে এলাকাগুলোয় দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে। সেসব এলাকার কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা নিজেরাও জানেন না কারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে তাদের ডাক দিলে রাস্তায় নেমে আসেন। তবে একজন শ্রমিক জানান, শ্রমিকদের ক্ষোভের অনেকগুলো কারণের একটি হলো শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা, যেখানে বলা আছে, ‘কোনও প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা বিভাগে বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে মালিক ওই শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্প‚র্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা কোনও মজুরি পাইবেন না।’ বেতন বকেয়া রয়েছে, এমন অনেক কারখানায় শ্রমিকরা এধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপেক্ষাকৃত ছোট কারখানার শ্রমিকরা নানা বৈষম্যের শিকার হয় এবং মালিকপক্ষের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ শ্রমিক ভুক্তভোগী হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরুষ শ্রমিক বনাম নারী শ্রমিকের দ্ব›দ্ব। কিছু কিছু কারখানায় পুরুষ শ্রমিকরা মনে করেন, তারা বৈষম্যের শিকার। নানা অজুহাতে তাদের চাকরিচ্যুত করে নারীদের কাজে নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধের দাবি জানান তারা। একাধিক শ্রমিক বলেন, ১৮ দফা দাবি মেনে নেয়ার পর আন্দোলন অতীতে হয়নি। এখন কেন হচ্ছে এবং কারা শ্রমিকদের উস্কানি দিচ্ছে তা গোয়েন্দা সংস্থাকে অনুসন্ধান করতে হবে। অতঃপর যারা এসব করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।এর আগে, ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে পোশাক শিল্পের বর্তমান সংকট নিরসনে করণীয় নিয়ে মতবিনিময় সভায় পোশাক মালিকরা বিশৃংখলা ঠেকানো না গেলে কারখানা বন্ধের হুঁশিয়ারি দেন। তৈরি পোশাক মালিকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানা চালু হওয়ায় বেশিরভাগ মালিক আপাতত খুশি হলেও অনেকের মধ্যে নতুন দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বাস্তবে সব কারখানায় নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি ও বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব হবে না। আর সেটা সম্ভব না হলে শ্রমিকদের কীভাবে সামলানো হবে, তা আমাদের জানা নেই। এছাড়া অনেকেই এখনও কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। কারখানার ভেতরে হুটহাট অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এতদিনেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল না কেন প্রশ্নে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগরের সভাপতি আবুল হোসাইন বলেন, সব কারখানার পরিস্থিতি একরকম না। কয়েকটি বড় কারখানা বাদে অসংখ্য ছোট কারখানাগুলো ১৮ দফা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। বকেয়া বেতন দিতে হবে, কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এখন শ্রমিকরা অধিকার সচেতন ও মালিকদের সান-শওকত বেড়েছে। কিন্তু মালিক শ্রমিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেনি। একাধিক শ্রমিক নেতা জানান, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি না ঘটার সুযোগ নিচ্ছে একটি মহল। তারা কারণে অকারণে গার্মেন্টস সেক্টরে বিশৃংখলা করে উৎপাদন বন্ধের চেষ্টা করছে।
এই বর্তমান পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস শিল্পে আর্থিক কী পরিমাণ ক্ষতির শঙ্কা করছেন আপনারা প্রশ্নে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যবসা হলে তবেই শ্রমিককে বেতন দিতে পারবে মালিকরা। এভাবে অস্থিরতা বিরাজ করলে ব্যবসা কমবে এবং পুরো খাতটাই অস্থির হয়ে থাকবে। আরও নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিবে। তিনি বলেন, যে কারখানা আজ বন্ধ তার আজকের দিনের কস্ট লস হবে, বন্ধ থাকলেও আজকের বেতন তাকে দিতে হবে, এই যে তিনি উৎপাদন করতে পারছেন না এর জন্য ক্রেতা তাকে কী করবে সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। ফলে নানাদিন থেকে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। আর্থিক ক্ষতিটাতো ভয়াবহ আকার নিবেই, যে ইমেজ ক্ষতি হবে সেটা পুনরুদ্ধারে বেগ পেতে হয় সবচেয়ে বেশি।