কেউ ধরেছেন অসুস্থতার ভান! কেউ কারণ ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত
মু.এ বি সিদ্দীক ভুঁইয়া:কেউ ধরেছেন অসুস্থতার ভান! কেউ কারণ ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত। কেউ আবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে নিয়ে লাপাত্তা। কোনো কর্মকর্তা ছেড়েছেন সরকারি বাসা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকেই জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ‘বিতর্কিত’ ১২ কর্মকর্তা এমনই নানা কীর্তি করে যাচ্ছেন।এ নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে সংসদ সচিবালয়।এই ১২ কর্মকর্তার নিয়োগ নিয়ে রয়েছে নানা গলদ,আছে সমালোচনা।গত দেড় দশকে মন্ত্রী এমপির পিএস পদসহ পছন্দের পদায়ন, বিদেশ সফর, সরকারি প্লট বরাদ্দসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়েছেন তারা। ‘অপরিহার্য কর্মকর্তা’ হিসেবে আত্তীকরণ করা হলেও সংসদের কাজে কখনোই তাদের একাগ্রতা ছিল না। অথচ তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতে একাধিকবার নিয়োগ বিধি সংশোধন করা হয়েছে। হাইকোর্ট তাদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করলেও আপিল বিভাগের রায়ে তারা চাকরিতে টিকে আছেন। তবে আপিল বিভাগের ওই রায় নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ।সর্বশেষ সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতদিন তারা স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে বেতন ভাতা নিয়েছেন। মামলায় হারলে বেতন ভাতা ফেরত দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন এই ১২ কর্মকর্তা। ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে তারা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও তুলে নিয়েছেন।
জাতীয় সংসদের সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্যাহ জানিয়েছেন, আত্তীকৃত এসব কর্মকর্তার অনেকেই দেড় মাস ধরে অফিসে অনুপস্থিত। তারা যে দায়িত্বে (ভিআইপির পিএস-এপিএস) ছিলেন, দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর সেই পদগুলো এখন আর নেই। নতুন করে তাদের পদায়নের বিষয়টি অপেক্ষমাণ রয়েছে।আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে রিভিউ আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়াইয়ের অধিকার সবারই আছে। তিনি বলেন, অতীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় হয়তো সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা হয়নি। আইনি দিক খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।সংসদ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন ও বিধির তোয়াক্কা না করে সপ্তম সংসদে শুধু দলীয় পরিচয়ে এসব ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর তিন দশক এই অপকর্মের ধারাবাহিক বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে নানা অনিয়ম আর অপকর্মে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন এসব কমকর্তা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও হুইপদের পছন্দে ‘প্রিভিলেইজ স্টাফ’ হিসেবে সংসদে যোগ দেওয়া কর্মকর্তার মধ্যে ২১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।সংসদ সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের কর্মচারী নন, এমন ব্যক্তিকে স্পিকারের ক্ষমতাবলে নিয়োগ দিয়ে ২০০০ সালের ৯ আগস্ট সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর সংস্থাপন মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারের কর্মচারী নন এমন ব্যক্তিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে আত্তীকরণের সুযোগ নেই।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের(পিএসসি)সুপারিশ ছাড়া প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে এমন নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায় সংসদসচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি। ২০০৬ সালে এ নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।এ মামলায় আত্তীকৃতদের পক্ষের আইনজীবী শিরীন শারমিন চৌধুরী পরে স্পিকার নির্বাচিত হন।হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে যান আত্তীকৃতরা। ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে ৪৬ বার আপিল শুনানির দিন ধার্য হলেও তা আর হয়নি।
কল্যাণ সমিতির সভাপতি আতাউল করিমের অভিযোগ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিএস পদে থেকে এম এ মাসুম (আত্তীকৃত ২১ জনের একজন) প্রভাব বিস্তার করে শুনানি ঝুলিয়ে রাখেন। ২০২০ সালে করোনাকালে ভার্চুয়াল কোর্টে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পরে ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর আত্তীকৃতদের পক্ষে রায় দেন আপিল বিভাগ। আপিল শুনানিতে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নির্দেশে সংসদ সচিবালয় এবং তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস আত্তীকৃতদের পক্ষে অবস্থান নেয়। আতাউল করিম জানান, আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসেও যোগাযোগ করেছেন তারা। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া মিলছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ পাওয়া ২১ কর্মকর্তার মধ্যে এখন ১২ জন চাকরিতে আছেন। বাকিরা অবসরে গেছেন। ১২ কর্মকর্তাকে গতকাল বুধবার এক আদেশে মানবসম্পদ-১ শাখায় (ওএসডি) পাঠানো হয়েছে। সংসদের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০০০ সালে পিএসসির নিয়োগ বন্ধ করে রাজনৈতিকভাবে আসা দলীয় ভিআইপির প্রিভিলেজ স্টাফ ও আত্মীয়স্বজনের ২১টি পদে আত্তীকরণের নামে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে নিয়োগবিধির শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স কিছুই মানা হয়নি। কোনো পরীক্ষা হয়নি।
তবে তাদের মধ্যে তিনজন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকলেও রেন্ট-এ কারের ব্যবসায়ীসহ সরকারি চাকরির কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। ৪৮ বছর বয়সে আবদুল হাই, ৪৬ বছরে সিরাজুল হোসেন বাদশা সহকারী সচিব/কমিটি অফিসার পদে নিয়োগ পান।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সংসদ সচিবালয়ে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে কমকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ২০০। এর মধ্যে যুগ্ম সচিব পদ রয়েছে মাত্র ছয়টি। এর মধ্যে পাঁচটি পদেই রয়েছেন আত্তীকৃতরা। এ ছাড়া সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তার জন্য সরকারি প্লট বরাদ্দেও একতরফা ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ রয়েছে। ৩ কাঠা ও ৫ কাঠার ১৫টি প্লটের মধ্যে ১১টি প্লটই নিয়েছেন আত্তীকৃত কর্মকর্তারা।
এখন তারা কোথায়
সাবেক হুইপ মিজানুর রহমানের এপিএস এম এ মাসুম প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। দু’দফা পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন উপসচিব। সর্বশেষ তিনি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর পিএস পদে ছিলেন। এর আগে তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিএসের দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছেন, আনিসুল হকের পিএস পদ থেকে সরে এলেও এম এ মাসুম সাব-রেজিস্ট্রার বদলি এবং কাজী নিয়োগ-বদলির কাজ করতেন। গত সপ্তাহে তিনি সংসদের কোয়ার্টার থেকে মালপত্র সরিয়ে নিতে গেলে কয়েকজন সাব-রেজিস্ট্রার তাঁর ওপরে হামলা চালান। এসব সাব-রেজিস্ট্রার পছন্দের স্থানে বদলির জন্য তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর বদলি হতে না পেরে এখন তারা সে টাকা ফেরত চাচ্ছেন। এ নিয়ে তর্কতর্কির এক পর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এম এ মাসুমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে তাঁর ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। সংসদের বাসায় গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি এখন অফিসেও যান না।
যুগ্ম সচিব এনামুল হক বলেন, ‘প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আমিও তুলে নিয়েছি। তবে সেটা তো পালিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। ৫ আগস্টের তাণ্ডবে সংসদের কোয়ার্টারে ব্যাপক ভাঙচুর ও তছনছ হয়েছে। এর মধ্যে তাঁর বাসাও রয়েছে। বাসা সংস্কারের জন্য টাকা তুলে নিয়েছি।’ সংসদ কোয়ার্টারের সরকারি বাসা মেরামত গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্ব– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে গণপূর্ত সংস্কারের কাজ করবে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। তাই প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে বাসা সংস্কার করেছি। যদিও আমি আর এক বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাব।’
সংসদ সচিবালয়ের জন্য রাজউকের নির্ধারিত ১১ প্লটের সবকটি আত্তীকৃতদের মধ্যে বণ্টনের বিষয়ে এনামুল হক বলেন, আত্তীকৃতদের বাইরেও দু-একজন পেয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ আমলে কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন– এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এসবের মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলাম না।
যুগ্ম সচিব আবদুল কাদের জিলানী সর্বশেষ চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর লিটনের পিএস ছিলেন। অফিস যোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমি ছুটিতে ছিলাম। এমনিতেও অফিস করার পরিবেশ নেই। নতুন সচিব যোগ দেওয়ার পর সমন্বয় সভায় আত্তীকৃতদের কেউ কেউ অংশ নেন। সেখানে সচিব সবাইকে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বলে শুনেছি।
যুগ্ম সচিব এ কে এম জি কিবরিয়া মজুমদার সাবেক রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের পিএসের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে মুজিবুল হক যখন হুইপ ছিলেন, তখন তাঁর পিএস ছিলেন। মজিবুল হক মন্ত্রী থাকার অবস্থায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ‘দোর্দণ্ড প্রতাপশালী’ হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। কথিত আছ, মন্ত্রণালয় পরিচালনায় মন্ত্রীর চেয়ে তাঁর ইচ্ছাই বেশি প্রাধান্য পেত।
মো. তারিক মাহমুদের খোঁজ নিতে গেলে তিনি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে আছেন বলে খুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়েছেন। অমলেন্দু সিংহ সাবেক হুইপ আবদুস শহীদের এপিএস ছিলেন। তাঁকে লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর আগে তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে অনিয়মিত কর্মকর্তা হিসেবে সুনামগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। দু’দফা পদন্নোতি পেয়ে তিনি এখন যুগ্ম সচিব।
সামিয়া হোসেইন সাবেক স্পিকারের এপিএস-২ ছিলেন। তিনি সহকারী সচিব পদে নিয়োগ পান। দু’দফা পদোন্নতির পর এখন তিনি উপসচিব। অন্য কর্মকর্তা মালেকা পারভীন, সুজিত কুমার দেব, মোছা. সালমা খাতুন ও মো. আলী আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।