দুদকের জালে আরও পাঁচ মন্ত্রী-এমপি - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুদকের জালে আরও পাঁচ মন্ত্রী-এমপি


মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন:অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আরও পাঁচ মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুকক)। দু-একদিনের মধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা দ্রুত কাজ শেষ করে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দেবে। বৃহস্পতিবার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংস্থার উপপরিচালক (জনসংযোগ) আখতারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তারা হলেন-সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের স্বত্বাধিকারী সালমান এফ রহমান, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এবং সংসদ-সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন। দুদকের কাছে অভিযোগ আছে, টানা ১৬ বছর আওয়ামী লীগের শাসন আমলে আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির হোতা ছিলেন সালমান এফ রহমান। বিভিন্ন মহলে তিনি ‘দরবেশ’ হিসাবেও পরিচিত। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি করেছেন। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি। ঋণের টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন রপ্তানিমুখী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে। এভাবে নানা অনিয়ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন সালমান এফ রহমান। তিনি কত টাকার মালিক তার প্রকৃত হিসাব বের করতে এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ শুরু করেছে।

জানা গেছে, ২০০৬-২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঋণখেলাপিসহ নানা অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। জেল থেকে বের হয়ে তিনি আর্থিক খাতের লুটপাটে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ২০১০-১১ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মাফিয়াও ছিলেন তিনি। শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা খতিয়ে দেখতে গঠিত কমিটি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে, সালমানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে অন্তত ৩৬ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। পণ্য রপ্তানি করে সেই অর্থ দেশে না আনার অভিযোগও রয়েছে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এছাড়া গেল ৩১ বছরে শেয়ারবাজারের প্রত্যেকটি বড় কেলেঙ্কারিতে সালমান এফ রহমান জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। গেল ৩ বছরে তিনি দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে নিয়েছেন ৬৬০০ কোটি টাকা। আর অদৃশ্যভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান। ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তিনি। হাজারো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথে বসানো এই মাফিয়ার সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করবে দুদক।

জানা গেছে, ২০১০-১১ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সেই রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সব ক্ষেত্রেই অনিয়মের সঙ্গে সালমানের নাম জড়িয়ে আছে। ইব্রাহিম খালেদের ওই তদন্ত প্রতিবেদনে তার বিষয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।আরও জানা গেছে, ২০০৬-০৭ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী একটি টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। টাস্কফোর্সের অসুন্ধানে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছিল। এর মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য ছিল সালমানের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, গত ১৬ বছরে বিদ্যুৎ খাতে বেপরোয়া লুটপাট হয়েছে। বৃহস্পতিবার যুগান্তরে ‘বিপুর মাফিয়া সিন্ডিকেট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কমিশন এই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে নসরুল হামিদ বিপুর অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের মহোৎসবের নেপথ্যে ছিল একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট। এর (সিন্ডিকেট) নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে সব অপকর্মকে নির্বিঘ্ন করতে যারা কলকাঠি নাড়তেন, তারা হলেন-সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মুখ্য সচিব-আবুল কালাম আজাদ ও আহমেদ কায়কাউস।জানা গেছে, একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি ধাপে ওই সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হতো। এর মধ্যে ছিল-প্ল্যানিং, সাইট ভিজিট, মেশিনপত্র অনুমোদন দেওয়া, নেগোসিয়েশন, প্রকল্পের সাইট সিলেকশন, মাটি ভরাট, জমি ক্রয়, বিদ্যুৎ ক্রয়ের দরদাম ঠিক করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করা বা কমিশনিং, মন্ত্রণাালয়ে রিপোর্ট পাঠানো, ক্রয় অনুমোদন, বিল অনুমোদন, বিল ছাড় করা। এসব কাজ করতে প্রতিটি ধাপে ঘুস গুনতে হতো। এসব দুর্নীতির বিষয়ে কাজ করবে অনুসন্ধান টিম।

বিগত দিনে দুর্নীতির শীর্ষ খাতের মধ্যে অন্যতম আরেক খাত তথ্যপ্রযুক্তি। সবশেষ এ খাতের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন জুনায়েদ আহমেদ পলক। আইসিটি সেক্টরের বিভিন্ন খাতের প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা তিনি তার ঘনিষ্ঠজনদের দিয়েছেন। সেখান থেকে মোটা কমিশন নেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।দুদক জানায়, সাবেক পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৫ বছর মেয়াদি ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার ‘সুফল প্রকল্প’ থেকে মন্ত্রী ও তার ছেলে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়ে ঠিকাদারকে কাজ দেয়। বিভিন্ন খাতে ভুয়া খরচ দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন মন্ত্রী। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। নূরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভোলা-৩ আসনের সংসদ-সদস্য থাকাকালে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে লালমোহন ও তজিমউদ্দিন উপজেলার টিআর-কাবিখা-কাবিটা প্রকল্পের বরাদ্দকৃত শত শত মেট্রিক টন চাল ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে বাইরে বিক্রি করে মোটা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

Top