আ.লীগ আমলে দখল ৩ ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা,ইসলামী ব্যাংকে গুলি, আহত ৩ - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আ.লীগ আমলে দখল ৩ ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা,ইসলামী ব্যাংকে গুলি, আহত ৩


মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দখল করা বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সরকার পতনের পর থেকেই বিভিন্ন দাবিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে টানা ৩ ধরে বিক্ষোভ চলছে। রোববার সেখানে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদিন আইএফআইসি ব্যাংক বিক্ষোভের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। আর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ২ দিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। আরও কয়েকটি ব্যাংকে চাপা উত্তেজনা আছে। এদিকে সরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কর্মীরা চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যে কোনো সময় এই ক্ষোভ প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।এদিকে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কয়েকটি ব্যাংকে শৃঙ্খলা পরিপন্থি যেসব কর্মকাণ্ড হচ্ছে তা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যাংকের মালিকানাসংক্রান্ত বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট আইন ধারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আইনের আওতায়ই এগুলো নিষ্পত্তি হবে। ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রাখার পাশাপাশি আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একই দিনে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংকে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এমডিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।ইসলামী ব্যাংকের ঘটনায় বিষয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংক দখল-পালটা দখল করতে দেওয়া হবে না। যারা এসব করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আইন অনুযায়ী ব্যাংক চলবে।এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র্র উপদেষ্টা ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যারা ব্যাংকে হামলা করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে ইসলামী ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা চলছে। রোববার সকালে রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়ের বাইরে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ব্যাংকের সামনে এখন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের সরিয়ে দিয়েছেন।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ব্যাংকটির পর্ষদ নিয়ন্ত্রণে নেয় এস আলম গ্রুপ। তারা আগের পর্ষদ সদস্যদের পদত্যাগ করিয়ে তাদের অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে। বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তির রদবদল করে ওই গ্রুপটিই ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ করছিল। ওই সময়ে তারা চট্টগ্রামের একটি এলাকার লোকদের প্রচলিত বিধিবিধান ভঙ্গ করে নতুন করে নিয়োগ দেয়। তারাই ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ করছিল। ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে ব্যাংকে ২০১৭ সালে দখলের আগে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। দখলের পর নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাংকে প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করেন। এতে ব্যাংকের একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।রোববার সকালে দখলের আগে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা ব্যাংকের সামনে অবস্থান নেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন দখলের পর যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের ব্যাংকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। এদিকে দখলের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা দিলকুশায় জড়ো হয়ে ব্যাংকে প্রবেশ করতে আসেন। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। চলে ধাওয়া-পালটাধাওয়া। ঘটনার এ পর্যায়ে পিস্তল দিয়ে গুলি চালানো হয়। এতে ৫-৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। পরে এদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পর নতুন নিয়োগ পাওয়া গ্রুপটি চলে যায়। তখন ব্যাংকের সামনে আগে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন ব্যাংকটি দখল করে এর আমানতকারীদের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। তখন কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। পাচারের টাকার সুবিধাভোগী সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজন।

ইসলামী ব্যাংকের পুরোনো কর্মীরা অভিযোগ করেছেন-দখলের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা গুলি ছোড়ার জন্য দায়ী। অনেকেই জানিয়েছেন, তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, একজন যুবক পিস্তল দিয়ে গুলি করছে। তিনি আগে থেকেই ব্যাংকের সামনে উপস্থিত ছিলেন। গুলিবিদ্ধদের রাজধানীর কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।ঘটনার পর ব্যাংকের সামনে সেনাবাহিনী চলে আসে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। দুপুরের পর ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলে। তবে দখলের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা ব্যাংকে আর প্রবেশ করতে পারেননি। ফলে তাদের আসনগুলো ফাঁকা ছিল।ওই ঘটনার পর ব্যাংকের সিবিএ নেতা আনিসুর রহমান জানান, ২০১৭ সালের পরে নিয়োগ পাওয়া যেসব নির্বাহী এখনও রয়েছেন, তাদের আর ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ২০১৭ সালের পর থেকে পরীক্ষা ছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেসব নিয়োগ বাতিল করা হবে। একই সঙ্গে ওই সময়ে পরে যাদের চাকরি অবৈধভাবে বাতিল করা হয়েছে, তাদের পুনরায় চাকরিতে বহাল করা হবে। এছাড়া গত ৭ বছরে যারা পদোন্নতি পাননি, তদের যথাযথভাবে পদোন্নতি দেওয়া হবে।এদিকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মওলা রোববার ব্যাংকে যাননি। পুরোনো কর্মীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, মুনিরুল মওলা ব্যাংকে ঢুকতে চাইলে তাকেও বাধা দেওয়া হবে।

এদিকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওই গ্রুপের বলয় থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছেন ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী। রোববার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, ওই গ্রুপ ও তাদের সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে নিয়ে পাচার করেছেন। ফলে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না। অর্থ সংকটের কারণে তাদের টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারীরা।

সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, ২০১৭ সালে এসআইবিএলের মালিকানা অস্ত্রের মুখে দখল করে নেয় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট একটি গ্রুপ। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের চরমভাবে হেনস্তা করে ১ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের যোগসাজশে অবৈধভাবে রাতের আঁধারে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। এরপর ব্যাংকটি লুটপাট করা হয়।এদিকে ব্যাংকটিতে ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা রোববারও মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান করেন। তাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রাম এলাকার বলে জানা যায়। এ সময় তাদের হাতে ২০১৭ সালের আগে নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা লাঞ্ছিত হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।এদিকে ৮ আগস্ট ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হকের নেতৃত্বে সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, রাব্বান আলীসহ কয়েকজন শেয়ারধারী ব্যাংকটিতে যান। এ সময় তারা ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে দ্রুত তাদের যুক্ত করার দাবি জানান। পাশাপাশি ব্যাংকটির অনিয়ম দূর করার দাবি জানান। এ সময় তাদের সঙ্গে ব্যাংকটির অনেক কর্মকর্তা যোগ দেন।

বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছিল আগে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলীর ফালুর নেতৃত্বাধীন পর্ষদের হাতে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এর নিয়ন্ত্রণ নেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তিনি এখন ব্যাংকের পর্ষদ চেয়ারম্যান। রোববার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেছেন। তারা বর্তমান চেয়ারম্যানসহ পর্ষদের পরিচালকদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। একই সঙ্গে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ এ সরোয়ারের সময়ে ‘অন্যায়ভাবে’ যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি করেছেন।

রাজধানীর পুরানা পল্টনে অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে রোববার ‘আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত সব কর্মকর্তা’ শীর্ষক একটি ব্যানার নিয়ে তিন শতাধিক লোক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন, আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তার সহযোগী হিসাবে কাজ করছেন সাবেক এমডি শাহ এ সরোয়ার, যিনি বর্তমানে ব্যাংকটির উপদেষ্টা। শাহ এ সরোয়ার ‘মানসিক চাপ সৃষ্টি করে’ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছেন।বিক্ষোভে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে নয় দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করা। তবে যারা ইতোমধ্যে চাকরির বয়স অতিক্রম করেছেন, তাদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধিসহ পাওনা পরিশোধ করা ইত্যাদি।

Top