অর্ধশত সিনিয়র কর্মকর্তা আত্মগোপনে
এ বি এম তারেক:যে পুলিশের ওপর রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিহিত ছিল, সেই পুলিশই এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। কেবল সাধারণ পুলিশ নয়, স্বয়ং পুলিশপ্রধান আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপারসহ সিনিয়র অসংখ্য কর্মকর্তা নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন। উচ্চপর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তাকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টারে নিরাপদ স্থানে যেতে হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন। শুধু তাই নয়, চরম ইমেজ সংকটেও পড়েছে এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের কোথাও এখন আর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে যেভাবে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, এর সব দায় এখন পুলিশের ওপর পড়েছে। রোববার রাতে একটি গুরুতপূর্ণ বৈঠকে হতাহতের জন্য পুলিশের ওপরই সব দায় চাপানো হয়।
জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ মঙ্গলবার বলেন, পলিটিক্যাল ক্রাইসিস পুরোটাই পুলিশের ওপর পড়েছে। স্বাধীন দেশে পুলিশ হচ্ছে চলমান সরকারের দৃশ্যমান বড় শক্তি। সরকার সব ধরনের দমন-পীড়ন পুলিশকে দিয়েই করায়। আমাদের মতো দেশে পুলিশের কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। পলিটিক্যাল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পুলিশ মাথা উঁচু করে বলবে ‘নো’-এই পুলিশকে তো আমরা সেভাবে গড়তে দিইনি। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনে আমরা যা দেখলাম, বিভিন্ন ইউনিটে আক্রমণ করে পুলিশ সদস্যদের যেভাবে পিটিয়ে, কোথাও আগুন দিয়ে বর্বরভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, এটি ভয়ংকর একটা বিষয়। এরপর পুলিশ কাজে যোগদান বা কাজে যাওয়া একটা কঠিন বিষয়। আস্থা ও বিশ্বাসটা দিতে হবে। এটি দিতে পারলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে যোগদান করবে। পুলিশের চেয়ে অপরিহার্য সংস্থা আর কোথাও নেই। এখন যেটা চলছে, কোথাও কোনো প্রশাসন নেই, পুলিশ নেই, জনপ্রতিনিধি নেই। এ অবস্থায় যদি কোনো এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে কে দেখবে? মানুষ যাবেটা কোথায়?
তিনি বলেন, আইজিকে আমি বলেছি যত দ্রুত সম্ভব একটা স্ট্যাটমেন্ট দিতে। যাতে বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অভিভাবকশূন্যতা বিরাজমান না থাকে। পরে অজ্ঞাত স্থান থেকে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন মঙ্গলবার বিকাল ৪টা ৮ মিনিটে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া সেল থেকে ২ মিনিট ৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি কোটা আন্দোলনের নেতাদের প্রতি অনুরোধ করে বলেন, পুলিশ ও পুলিশি স্থাপনায় যাতে হামলা না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিন। চিকিৎসাধীন পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন।
পুলিশ স্টাফ কলেজের অতিরিক্ত ডিআইজি সোহেল রানা রিতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছেন, বাহিনী নয়, পুলিশের নেতৃত্বে সমস্যা ছিল। দোষীরা শাস্তি পাবে। দয়া করে নিরীহ পুলিশ সদস্যদের আক্রমণ করবেন না। এ মুহূর্তে দেশ ও জাতির মতো বাংলাদেশ পুলিশও একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দৃশ্যত বাংলাদেশ পুলিশ এখন নেতৃত্বহীন। অভিযুক্তরা গা ঢাকা দিয়েছেন। জুনিয়র কর্মকর্তা ও সদস্যরা দিশেহারা। তারা সবাই নিরীহ সদস্য। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান রক্ষার উদ্দেশ্যে সবার সহযোগিতা চান এই কর্মকর্তা।
এদিকে মনোবল ভেঙে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের উজ্জীবিত করতে কাজ করছেন ২০ বছর ধরে পদ-পদোন্নতিবঞ্চিত ১২, ১৫, ১৭, ১৮, ২০, ২২ ও ২৪ বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের অন্তত ২০ জন সিনিয়র কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তা মঙ্গলবার নিউ ইস্কাটনের পুলিশ অফিসার্স ম্যাসে জরুরি বৈঠকে বসেন। তাদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তারা কথাবার্তা বলেছেন। বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা হয়েছে। বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের কাছে তুলে ধরার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করে একজন অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন,পুলিশকে নজিরবিহীনভাবে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োজিত করার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। এ পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিচ্ছিন্নভাবে ঘটছিল কয়েকদিন ধরেই। আর সোমবার শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে থাকা সদস্যরা জাতীয় শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। এর দায় দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছুতেই এড়াতে পারবেন না।তিনি বলেন, জনরোষ থামানোর কোনো শক্তি আমাদের ছিল না। এমনকি সক্ষমতাও নেই। কে কার ওপর নির্বিচারে গুলি চালাবে? কার সন্তান নেই যে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে না। পুলিশে চাকরি যারা করেন, তাদের মধ্যে কি মনুষ্যত্ব থাকবে না? দিন শেষে ডিউটি করে পুলিশের যে সদস্য বাসা-বাড়িতে ফেরেন, তখনও ছেলে-মেয়েদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে অনেককে। পুলিশসহ শত শত হতাহতের ঘটনার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। এখন কে নেবে এই দায়িত্ব? সব সিনিয়র কর্মকর্তা আত্মগোপনে।
আত্মগোপনে যারা : পুলিশের ওই বৈঠক থেকে জানানো হয়, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরই নিজেকে আড়াল করে নেন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত গোপালগঞ্জের কৃতীসন্তান ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) কামরুল আহসান, অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) মো. আতিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজিপি কৃষ্ণপদ রায়, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন, ডিআইজি ক্রাইম জয়দেব কুমার ভদ্র, বহুল আলোচিত ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি হারুন-অর-রশীদ, ডিবির জয়েন কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার অতিরিক্ত ডিআইজি মেহেদী হাসান ও অতিরিক্ত ডিআইজি সুদীপ চক্রবর্তী। এছাড়া রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপারসহ মাঠ পর্যায়ের প্রায় সবাই নিজেদের আড়াল করে নেন। মাঠে ছিল থানা পুলিশ, রায়ট, রিজার্ভ ফোর্সের কনস্টেবল, এসআই ও এএসআই। হতাহত সংখ্যার মধ্যে অন্তত ৯৮ ভাগ অধস্তন পর্যায়ের। এ কারণে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অন্তত ৪০ হাজার এসআই। নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্র আন্দোলনের মতো পুলিশেও আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। তবে এটা বাইরে প্রকাশ হয় না। ভেতরে জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়েছেন-এমন অফিসারের সংখ্যাও কম নয়। দুই দশক ধরে প্রমোশনবঞ্চিত আছেন অন্তত শতাধিক কর্মকর্তা। দীর্ঘ বছর তারা পুলিশের অবহেলিত বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত। পুলিশের এই সংকটময় মুহূর্তে এসব কর্মকর্তাই দায়িত্ব নিয়েছেন। ব্যক্তি ইমেজ নিয়ে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন পুলিশের আইজি পদে দুই দফায় অতিরিক্ত সময় নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও এ সংকটে তিনিও গা ঢাকা দিয়েছেন। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো লাখ লাখ মানুষ কারফিউ ভঙ্গ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়। সেই ধারাবাহিকতায় ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত পুলিশ সদর দপ্তরেও ঢুকে ভাঙচুর করে।এ সময় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন একজন কনস্টেবল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের মূল ফটকে আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে আইজিপি, কমিশনারসহ সিনিয়র কর্মকর্তারা ছাদে উঠে পড়েন। সেখান থেকে র্যাবের হেলিকপ্টার এনে তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন একজন অতিরিক্ত ডিআইজি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা দেশের নৈরাজ্যকর এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারেন,সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্দেশ দিয়ে যেসব নিরীহ কনস্টেবলকে জনরোষে ফেলেছেন, তারাই বিত্তশালী কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত।এসব কর্মকর্তাকে ব্ল্যাক লিস্টে রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পুলিশের নানা ধরনের কেনাকাটাসহ সরাসরি জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো পদে রাখা হবে না। ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে সাজানো হবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসন।এছাড়া ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হবে। আয়বহির্ভূত সম্পদশালী কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছেন।