বাসে‘গলাকাটা’ ভাড়া,দুই মহাসড়কে ভোগান্তি - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাসে‘গলাকাটা’ ভাড়া,দুই মহাসড়কে ভোগান্তি


ইমন হাওলাদার:শেষ সময়ে এসে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা এবারও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়নি। এ দুই মহাসড়কের গাজীপুরের শিল্পঘন এলাকাতে গতকাল শনিবার দিনভর ছিল যানজট। কোথাও থেমে থেমে চলে গাড়ি। যানবাহন সংকটের সুযোগে বাসে গলাকাটা ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বাসের বাড়তি ভাড়ায় টিকতে না পেরে অনেক দরিদ্র মানুষ ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক-পিকআপে যাত্রা করেন।তবে স্বস্তি ছিল আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রায়। ঢাকা থেকে অধিকাংশ ট্রেন ৫ থেকে ৩০ মিনিট বিলম্বে যাত্রা করলেও শিডিউল বিপর্যয় হয়নি। যদিও ইঞ্জিন-বগি সংকট এবং রেলের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতি কাজ না করায় এবারের ঈদে ভোগান্তির শঙ্কা ছিল।আগের দিনের চেয়ে গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ঈদযাত্রা ছিল স্বস্তির। গাড়ির চাপ থাকলেও যানজট হয়নি। ঢাকা-খুলনা এবং ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কেও যানজট ছিল না। এ দুই মহাসড়কের প্রবেশপথ ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতেও যানজট দেখা যায়নি। তবে রাজধানী ছেড়ে এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছাতে পোস্তগোলা সেতু পর্যন্ত যেতে তীব্র যানজট ছিল গতকাল দুপুর পর্যন্ত।সরকারি অফিসে গত বৃহস্পতিবার শুরু হয় ঈদের ছুটি। সেদিন দুপুর থেকে সড়কে যাত্রীর চাপ বাড়ে। শিল্পকারখানাসহ অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটি শুরু হয় গতকাল। তাই এদিন দুপুর থেকে সাভার,আশুলিয়া, গাজীপুরের টঙ্গী, কালিয়াকৈর এলাকায় মহাসড়কে যাত্রীর ঢল নামে।শিল্পকারখানার ছুটিতে কোথাও কোথাও যানজট হচ্ছে, তা স্বীকার করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কিছু কিছু জায়গায় যানজট হলেও কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। এবার সড়কে অনেক বেশি যানবাহন। যানবাহনের ভিড় অনেক বেশি। কোথাও যানজট হচ্ছে না, তা অস্বীকার করে লাভ নেই।

ঢাকা ছাড়তে এবারও ভোগান্তি
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় মহাসড়কে যানজট না থাকলেও হানিফ ফ্লাইওভার পার হতেই গতকাল কয়েক ঘণ্টা লেগেছে। সাংবাদিক আমিন আল রশিদ ফেসবুকে লিখেছেন, শনিবার সকাল পৌনে ৭টায় পান্থপথ থেকে রওনা হয়ে ৯টা ৪০ মিনিটে পোস্তগোলা সেতুতে পৌঁছান। মাত্র ১২ কিলোমিটার পথ যেতে তিন ঘণ্টা লেগেছে।বেলা ১১টার দিকে দেখা যায়, রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে ‌উত্তরার আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত পুরো পথ ফাঁকা। তবে আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের টঙ্গী, বোর্ড বাজার, ভোগরা, চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে সালনা পর্যন্ত পুরো পথেই গাড়ির দীর্ঘ সারি। ময়মনসিংহের যাত্রী জাহিদুর রহমান জানান, আবদুল্লাহপুর থেকে সালনা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পথে বাসে দুই ঘণ্টা লেগেছে।

বাসের জন্য অপেক্ষা
গাজীপু‌রের যান‌জটে ঢাকায় বাস ফির‌ছে দে‌রি‌তে। এতে রাজধানীর মহাখালী টা‌র্মিনালে বাস সংকট দেখা দেয়। শ‌নিবার দুপুর ১২টায় দেখা যায়, হাজা‌রো যাত্রী প্রচণ্ড গরমে বা‌সের অপেক্ষায় আছেন। তা‌দের ভোগা‌চ্ছে বাড়‌তি ভাড়াও। এনা প‌রিবহন ছাড়া মহাখালী থে‌কে চলা সব প‌রিবহ‌নের বা‌সে বাড়তি ভাড়া নে‌ওয়া হ‌চ্ছে।মহাখালীর টা‌র্মিনা‌লের প‌রিবহনগু‌লো আগাম টি‌কিট বি‌ক্রি ক‌রে না। এখান থে‌কে উত্তরবঙ্গ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাস চ‌লে। শ‌নিবার দুপু‌রে এনা প‌রিবহ‌নের টি‌কিট কাউন্টা‌রের সাম‌নে ছিল হাজারখা‌নেক যাত্রী। সা‌রির শুরুর দি‌কে ময়মন‌সিংহের যাত্রী আবু নেসার সুখন ব‌লেন, দুই ঘণ্টা দাঁ‌ড়ি‌য়ে আছি। টি‌কিট দি‌চ্ছে না।

এনা প‌রিবহ‌নের সহকারী ব‌্যবস্থাপক এস এম খা‌লেদ সমকাল‌কে ব‌লেন, সকাল থে‌কে ৬৩‌টি বাস ছে‌ড়ে‌ছে। ৬৫ নম্বর পর্যন্ত বা‌সের টি‌কিট বি‌ক্রি করা হ‌য়ে‌ছে। পরবর্তী বাস কখন ঢাকায় ফির‌বে, নিশ্চয়তা নেই। তাই টি‌কিট বি‌ক্রি বন্ধ।১১০ কি‌লো‌মিটার দীর্ঘ ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে স‌র্বোচ্চ তিন ঘণ্টা সময় লা‌গে। ত‌বে শ‌নিবার ময়মন‌সিংহ থে‌কে ফির‌তে সাত ঘণ্টা পর্যন্ত লাগছে বলে জানান এস এম খা‌লেদ। তি‌নি ব‌লেন, বাস সময়ম‌তো না ফেরায় ছাড়‌তেও দে‌রি হ‌চ্ছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে সরকার নির্ধা‌রিত ভাড়া ৩২০ টাকা। শুধু এনা প‌রিবহনে তা নেওয়া হচ্ছে। সৌ‌খিন, শ‌্যামলী বাংলা, আলম এশিয়া প‌রিবহ‌নে অন‌্য সম‌য় দুই থেকে আড়াইশ টাকা নেওয়া হ‌লেও গতকাল নিয়েছে ৪০০ থে‌কে ৫০০ টাকা। শ‌্যাম‌লী বাংলার বা‌সে (ঢাকা মে‌ট্রো ব-১২-৩৩৯৮) ৪০০ টাকা ভাড়া হাঁকি‌য়ে যাত্রী তোলা হচ্ছিল। হাঁক দেওয়া চাল‌কের সহকারী বল‌লেন, ভাড়া ছিল ৫০০। ১০০ কম নি‌চ্ছি। সরকার নির্ধা‌রিত ভাড়ার চে‌য়ে ৮০ টাকা বাড়‌তি নেওয়ার বিষ‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, বাস খা‌লি আসে। তাই বাড়‌তি নি‌তে হয়।বাড়‌তি ভাড়া নি‌লে ক‌ঠোর ব‌্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়া‌রি দি‌য়ে‌ছিল সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআর‌টিএ)। তবে বাস টা‌র্মিনা‌লে সংস্থার কাউকে দেখা যায়‌নি।

দুই মহাসড়কে দুর্ভোগ

গাজীপুর ও কালিয়াকৈর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল গাজীপুরের প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানায় ছুটি শুরু হয়। এতে দুপুর থেকে যাত্রীর ঢল নামে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চন্দ্রা, নবীনগর, বাইপাইল ও আশুলিয়া এলাকায়। সন্ধ্যায় চন্দ্রা এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ছিল। মোড় পার হতে ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। হাজারো মানুষ সড়কে ভিড় করায় কমে গাড়ির গতি। পুলিশের তৎপরতা থাকলেও বহু গাড়ি সড়কে থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়। এতে যানজট আরও বাড়ে। বাস না পেয়ে হাজারো মানুষ চড়েন ট্রাক-পিকআপে।একই অবস্থা ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে সালনা অংশে। সরেজমিন দেখা যায়, দুপুর থেকে যাত্রীর ঢল শুরু হয় এ অংশে। তবে হাইওয়ে পুলিশের নাওজোড় থানার ওসি শাহাদাত হোসেন বলেন, মহাসড়কে যানজট নেই। একই দাবি মাওনা হাইওয়ে থানার এসি শেখ মাহবুব মোর্শেদের।

গলাকাটা ভাড়া
গাজীপুরের দুই মহাসড়কে পরিবহন সংকটে বাসে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হয়েছে। চান্দনায় বাসের অপেক্ষায় থাকা ময়মনসিংহের যাত্রী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভাড়া দেড়শ। কিন্তু চাইতাছে ৫০০।

চন্দ্রায় বাসের জন্য প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে রংপুরের যাত্রী কামাল হোসেন বলেন, ‘দুই ঘণ্টায় বাস পাইনি। ১ হাজার ২০০ টাকা ভাড়া চায়। অথচ অন্য সময়ে ৬০০ টাকা নেয়। বাসে যাওয়ার উপায় নেই। ৩০০ টাকায় ট্রাকে যাব।ঢাকা-ঝিনাইদহ রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৬৪৯ টাকা। কিন্তু রয়াল পরিবহন টিকিট দিয়ে ৯০০ টাকা করে নিচ্ছে।বিআরটিএ টোল ধরে ভাড়া নির্ধারণ করলেও প্রতিষ্ঠানের উত্তরা কাউন্টারে ব্যবস্থাপক আবু সালেহ জানালেন, পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ায় ভাড়া বেশি।

ট্রেনে স্বস্তি, তবে ছাদে যাত্রী
গতকালও অনেকটাই সময়মতো চলেছে ট্রেন। যাত্রার আগে আন্তঃনগর ট্রেনে শোভন শ্রেণির আসনের জন্য ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট দেওয়া হয়। গতকাল এ টিকিটের জন্য স্টেশনে ভিড় করেন হাজার হাজার যাত্রী।

কমলাপুরে বিনা টিকিটের যাত্রীদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। একই ব্যবস্থা রয়েছে বিমানবন্দর স্টেশনে। তবে গতকাল সন্ধ্যার দিকে টিকিট না পাওয়া বহু মানুষ স্টেশনে ঢুকে পড়েন। উত্তরবঙ্গ এবং ময়মনসিংহের পথের ট্রেনের ছাদেও ছিল যাত্রী। এ সময় টি‌কিট পে‌য়েও ভি‌ড়ের চা‌পে অনেক যাত্রী ট্রেনে উঠতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন।

বহু ক‌ষ্টে কু‌ড়িগ্রাম এক্স‌প্রেসের চার‌টি টিকিট পে‌য়ে‌ছি‌লেন মো. রাজুর প‌রিবার। কিন্তু ট্রেনে চড়‌তে পা‌রেন‌নি। গতকাল রাজু এবং তাঁর ভাই স্ত্রী ও সন্তান‌দের নি‌য়ে আসেন কমলাপু‌র স্টেশনে। রাত পৌ‌নে ৯টায় ছাড়ার কথা ছিল ট্রেন‌টির। কিন্তু ভি‌ড়ের চা‌পে তারা ট্রেনে উঠ‌তে পা‌রে‌ননি। রাত পৌ‌নে ১০টায় ট্রেন‌টি ছে‌ড়ে যায় কমলাপুর থে‌কে। ট্রেনে উঠতে না পে‌রে রাজু প্রতিকার চাইতে আসেন স্টেশন ম‌্যা‌নেজা‌রের ক‌ক্ষে। তিনি ক্ষো‌ভে চিৎকার ক‌রে বল‌ছি‌লেন, ১ হাজার ৩০০ টাকা ক‌রে টি‌কিট কি‌নে‌ছেন। বিনা‌ টি‌কি‌টের যাত্রী‌দের ভি‌ড়ে ব‌গিতেই ঢুক‌তে পা‌রে‌নি তারা।

সাংবা‌দিক ল‌তিফুল ইসলামও কুড়িগ্রাম এক্স‌প্রেসের টি‌কিট কে‌টেও উঠ‌তে পা‌রে‌ন‌নি। স্ত্রী ও ছোট দুই ভাইকে নি‌য়ে ফেরত যান বাসায়।রাত সোয়া ১০টার লালম‌নি এক্স‌প্রেসেও ঠাসা ভিড় দেখা যায়। শুধু উত্তরব‌ঙ্গের ট্রেন নয়, একই অবস্থা ছিল ময়মন‌সিংহ হ‌য়ে চলা ট্রেনগু‌লো‌তে। ছা‌দেও ছিল শত শত যাত্রী।

Top