ব্যাংক খাতের প্রধান ক্ষত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি
মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম : ব্যাংক খাতের প্রধান ক্ষত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। নানা পদক্ষেপ নিয়েও এ ক্ষত সারতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। উলটো দিন দিন বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ। ১ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা এবং ৩ মাসে বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। ১ বছর আগে ২০২৩ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ হাজার কোটি টাকা এবং গত ডিসেম্বরে ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ব্যাংকাররা বলছেন, সুশাসন ও খেলাপি ঋণই বর্তমান ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা। ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার কারণে দিন দিন খেলাপি বাড়ছে। এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় না দিয়ে পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। একই বছরের জুনে ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। ওই বছরের মার্চে ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মেনে রাষ্ট্র মালিকানাধীন চারটি ব্যাংককে জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মার্চ পর্যন্ত কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এই সীমার মধ্যে আসেনি। কারণ, কোন কৌশলে খেলাপি ঋণ কমানো হবে, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারি খাতের বেশিরভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ না কমে উলটো বেড়েছে। সংখ্যাটির শর্ত অনুযায়ী পুরো ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। কিন্তু খেলাপি না কমে উলটো বেড়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মার্চ পর্যন্ত ঋণের অঙ্ক তিন লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এই ঋণের ২৭ শতাংশ খেলাপি। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ ১২ লাখ ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। যার খেলাপি ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ আর বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ৫ দশমিক ২০ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের যে অঙ্ক প্রকাশ করেছে এটা প্রকৃত তথ্য নয়। খেলাপি ঋণ এর চাইতেও অনেক বেশি। অর্থ ঋণ আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টের মামলাগুলোতে আটকে থাকা খেলাপি ঋণকে জাস্টিফাইড ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে, পাঁচ বছরের পুরোনো মন্দ ঋণ সেটা কিন্তু খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এই দুটোকে যোগ করলে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এ অর্থনীতিবিদ ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার যদি ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কঠোর না হয় এবং একটা স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা না করে তাহলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না।পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের ব্যাংক খাতের প্রকৃত খেলাপি আরও অনেক বেশি। মূলত আইএমএফের শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অবলোপনসহ ঋণের নানা ক্যাটাগরি বাদ দিতে হচ্ছে। এজন্য দেশের প্রকৃত খেলাপি ধীরে ধীরে উঠে আসছে। শর্ত সঠিকভাবে পরিচালন হলে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে যাবে।