৫ মাসে সর্বনিম্ন বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি
মু.এবি সিদ্দীক ভুঁইয়া :দীর্ঘদিন থেকে দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মিশ্র রফতানি প্রবৃদ্ধি, ডলার সঙ্কট ও অতিরিক্ত দাম, নিয়ন্ত্রিত আমদানি, প্রবাসী আয় ও রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ, রাজস্ব আদায় এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপসহ আর্থিক খাতের সব সূচকই নিম্নমুখী। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদহার হু হু বেড়ে যাওয়া এবং সর্বশেষ মার্জার বা একীভূতকরণ নিয়ে ব্যাংকিংখাতে অস্থিরতায় ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারনে উৎসাহ হারাচ্ছেন। এদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রিত আমদানি নীতিতে আমদানি ব্যাপক কমেছে। এখন প্রতি মাসে এলসি খোলা হচ্ছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার করে এলসি খোলা হয়েছে। সে কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৫৯ বেসিস পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ, যা গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের মাস মার্চে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা ওই সময়ে নয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১০ শতাংশ। যা এপ্রিলে এসেই কমেছে। এদিকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের পর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি জুনে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের নিচে নামানোর প্রাক্কলন করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এটি ৮ শতাংশের নিচে নামানোর ঘোষণা দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। সর্বশেষ মে মাসে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৮৯ শতাংশ। গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই হিসেবে নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করে আসছেন। বাস্তবে অনেক আগেই মূল্যস্ফীতি অনেক আগেই দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়েছে বলে মত তাদের। আর রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে আসন্ন বাজেটে আমদানি সংকোচন, তারল্য প্রবাহ কমিয়ে সুদহার বৃদ্ধি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে সরকারকে। এর ফলে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে যাচ্ছে। এ ছাড়া ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনার পাশাপাশি ঋণ ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও মূলধনি বিনিয়োগ কমে গেছে, যা কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
অগামীতে ব্যবসার খরচ আরও বেড়ে যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, শিল্পের কাঁচামালের জন্য শুল্ক বাড়ানো হলে, এটার প্রভাব সরাসরি পড়বে পণ্যের ওপর। যা ভোক্তার ওপর অবশ্যই অসবে। তিনি বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যেতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আশরাফ আহমেদ বলেন, এটার জন্য রফতানি সক্ষমতা কমবে না; কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা চাপ পড়বে। এর কারণ হলো খাদ্যের বাইরে যেসব পণ্য আছে, সেগুলোর মূল্যস্ফীতি খুব বেশি না। যখনই কাঁচামালের দাম বাড়ে আমাদের ক্যাপিটাল মেশিনারিজের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন আমরা যদি ব্যাংকের ঋণ না বাড়াতে পারি, তখন পণ্যের সক্ষমতার ওপর চাপ পড়বে; অর্থাৎ ঋণের প্রবাহ কমে গেলে মন্দার অবস্থা তৈরি হয়।
ব্যাংকাররা বলছেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধি কমেছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে মার্চে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এপ্রিল মাসের দুই-তৃতীয়াংশ ঈদ-পরবর্তী সময় হওয়ায় এ মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের মন্থর গতির কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণ কম করছেন। এছাড়া ঋণের সুদ বেড়ে ১৪ শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। যার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হারকেও বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ধারবাহিকভাবে ডলারের রেট বাড়ছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি করার ক্ষেত্রে নানা হিসাব করছেন। যার কারণে প্রবৃদ্ধি কমছে।ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গত দুইবারের মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করা করেছে। এর ফলে সব ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কম। মার্চে রমজানের কারণে খাদ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে। সে কারণে এই মাসে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেশি ছিল। এপ্রিলে কমেছে, কারণ এই মাসের প্রায় ২০ দিন ছিল ঈদ-পরবর্তী সময়। সে কারণে ব্যবসায়ীদের ঋণের চাহিদাও কম ছিল।
একটি সরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি এলসিতে মার্জিন আরোপ করায় গত দুই বছরে আমদানি ব্যাপক কমেছে। এখন প্রতি মাসে এলসি খোলা হচ্ছে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার করে এলসি খোলা হয়েছে। সে কারণে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে কমেছে ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ ও ১৩ দশকি ৯৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৫১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।চলতি অর্থবছরে প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে। এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নিষ্পত্তি ২৫ দশমিক ০৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি ঋরেণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এরপর থেকে টানা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। তবে অক্টোবরে কিছুটা বেড়ে ১০ দশমিক ০৯ শতাংশ হয়েছিল; এরপর ফের নভেম্বরে কমে যায়। যদিও ডিসেম্বরে নভেম্বরের তুলনায় মার্জিনাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে।চলমান মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ধরনের অর্থ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা জুনের জন্য কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ১১ শতাংশ। এছাড়া, সর্বোপরি অর্থ সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে।কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার আগপর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, মে মাসেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাজারে বেসরকারি খাতের ঋণের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তার তুলনায় প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম। কারণ হচ্ছে অনেক ব্যাংক তারল্য সঙ্কটে রয়েছে। এছাড়া গত দেড় বছর ধরে দেশের আমদানির প্রবৃদ্ধিও কম রয়েছে।