দেশের ২০ জেলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে,৬ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার বেশি
মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম :রিমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উপকূলের ২০ জেলার ৬২ উপজেলার ৪১৯টি ইউনিয়ন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ বাড়িঘর। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় বিধ্বস্ত হয়েছে ১১৬৩টি। প্রায় ৯৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমির ফসল ধ্বংস হয়েছে। বিদ্যুৎসেবা থেকে বঞ্চিত প্রায় তিন কোটি তিন লাখ গ্রাহক। ২০ জেলায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার ৮৮ কোটি ২৫ লাখ ৬ হাজার ৭১ টাকা।আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রিসেন্টের কাছে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে সহায়তা চেয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান কেট ফবস বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছেন। রোববার সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মো. মহিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এ সময় প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে সহায়তা চেয়েছেন বলে প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানান।
এদিকে রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রিমালে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ভূমি সচিব, পানিসম্পদ সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, ত্রাণ সচিবসহ ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভাশেষে প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানান, এ পর্যন্ত রিমালে ১৮ জনের প্রাণহানি খবর পাওয়া গেছে। উপকূলের ২০ জেলায় এ পর্যন্ত নগদ পাঁচ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫শ মেট্রিক টন চাল, নয় হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, দুইশ ভান্ডিল ঢেউটিন, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৪৫ লাখ টাকার জিআর ক্যাশ এবং গোখাদ্য ক্রয়ের জন্য ৪৫ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কার্যক্রম চলছে এবং আগামী ৯ মার্চ ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে আবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। তখন বলা যাবে প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রিমালের আঘাতে পায়রা সেতুর বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, পায়রা সেতুর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা মেরামতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লেগে যাবে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০ জেলায় প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র হচ্ছে-বাগেরহাট জেলায় ৮১৪ কোটি ১৯ লাখ ২৬ হাজার ৯২৩ টাকা। বরগুনা জেলায় ৮৯৮ কোটি ৯৭ লাখ ৯২ হাজার ৫২৯ টাকা। বরিশাল জেলায় ৩০৯ কোটি ৯৮ লাখ ২৪ হাজার ৬১৭ টাকা। ভোলা জেলায় ৩৭১ কোটি ৬৯ লাখ ৬১৬ টাকা। চাঁদপুর জেলায় ১৬ কোটি ২৪ লাখ ৭০ হাজার ১৭০ টাকা। চট্টগ্রাম জেলায় ৪২ কোটি ৭২ লাখ ৬১ হাজার ১৭৫ টাকা। কক্সবাজার জেলায় ১২ কোটি ৭২ লাখ ৭১ হাজার ৪০১ টাকা। ফেনী জেলায় ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। ঝালকাঠি জেলায় ৪২২ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ২৭৭ টাকা। খুলনা জেলায় ২ হাজার ১১০ কোটি ১৬ লাখ ১৯ হাজার ১১৬ টাকা। লক্ষ্মীপুর জেলায় ৭৬ কোটি ৯৩ লাখ ২৭ হাজার ৮৫০ টাকা। নোয়াখালী জেলায় ২৪৮ কোটি ৫৬ লাখ ৯৪ হাজার ৭৯৭ টাকা। পটুয়াখালী জেলায় ৭২৭ কোটি ৯৫ লাখ ৫৬ হাজার ৩১৩ টাকা। পিরোজপুর জেলায় ৪৫৫ কোটি ৯৩ লাখ ৪৮ হাজার ১১৯ টাকা। সাতক্ষীরা জেলায় ১২১ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৩০৬ টাকা। যশোর জেলায় ৫ কোটি ৮৯ হাজার টাকা। গোপালগঞ্জ জেলায় ১৭৫ কোটি ৭৯ লাখ ৮ হাজার ৫৫৬ টাকা। নড়াইল জেলায় ১৭ কোটি ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৫শ টাকা। শরীয়তপুর জেলায় ৪১ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৪ টাকা এবং কুমিল্লা জেলায় ৭ কোটি ৮ লাখ ৮০ হাজার ৪৪৭ টাকা।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৮৮১টি স্থাপনার ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এক লাখ মৎস্য খামার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫০০টি মাছ ধরা ট্রলার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) হিসাব অনুসারে সংস্থাটির ৩ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ৭০২ জন গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। বিদ্যুতের কয়েকশ খাম্বা ভেঙে পড়েছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন সব গ্রাহককে পুনঃসংযোগ দিয়েছে। প্রাথমিক তথ্যানুসারে ১০৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির মধ্যে ৬০টি সমিতির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেছে। বাকি ২০টি সমিতির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে মাঠ পর্যায়ে ১৭ হাজার মানুষ কাজ করছেন। রিমালের আঘাতে বৈদ্যুতিক মিটার ক্ষতি হয়েছে ৫৯ হাজার ৩৯৯টি। তার মধ্যে সচল করা হয়েছে ৫৮ হাজার ৩৩টি এবং এখনো ১৩ হাজার ৬৬টি মিটার সচল করা সম্ভব হয়নি। এখনও প্রায় ৫৭ হাজার ৫৫০ জন গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমালের আঘাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬১ কোটি ৯২ লাখ ৩৩ হাজার ৭১৬ টাকা। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে গরু মারা গেছে ৩০৪টি, মহিষ ৩৮৭টি, ছাগল ৬৮৬টি, ভেড়া ৬১৬টি, মুরগি ২ লাখ ৩৮ হাজার ২৩৮টি এবং হাঁস ২৭ হাজার ৯০৮টি। পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত ৬ কোটি ৭৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকার খড় ভেসে গেছে। ৫ কোটি ৪৯ লাখ ৮৬ হাজার ৯২০ টাকার ঘাস ভেসে গেছে। পশুপাখির দানাদার খাদ্য বিনষ্ট হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি ৮ লাখ টাকার। হাঁস ও মুরগির খাবার ভেসে গেছে ৮ কোটি ২৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকার।স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ে শতাধিক কমিউনিটি ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখনো সঠিক পরিসংখ্যান তাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। সে কারণে আংশিক তথ্য তারা গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
চট্টগ্রামে ৪২ কোটি টাকার ক্ষতি : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৮ উপজেলায় ৪২ কোটি ৭২ লাখ ৬১ হাজার ১৭৪ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে। এ উপজেলায় ২৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোববার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার এ তথ্য জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় রিমালে বাঁশখালী, লোহাগাড়া, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, সন্দ্বীপ, আনোয়ারা কর্ণফুলী ও চন্দনাইশ উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বাঁশখালী উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৮৫ হাজার, লোহাগাড়ায় ৩৯ লাখ ৭৫ হাজার, সীতাকুণ্ডে ১ কোটি ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৫০০, মিরসরাইয়ে ২ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০, সন্দ্বীপে ২৮ কোটি ৮৮ লাখ ২৫ হাজার ১৭৪ টাকা, আনোয়ারায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা, কর্ণফুলীতে ৫৮ লাখ এবং চন্দনাইশে ৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ৭টি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রিমালে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এগুলো হলো হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, ফটিকছড়ি, সাতকানিয়া ও পটিয়া।জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে চট্টগ্রামে ১৫৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ও পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে ৬ হাজার ৩৬৮ জন মানুষ। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৩ কোটি টাকা নিরূপণ করা হয়েছে।