উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সম্পৎশালীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে
মোহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম:উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সম্পৎশালীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। তৃতীয় ধাপেও চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ৬৭ শতাংশই ব্যবসায়ী। এর মধ্যে কোটিপতি প্রার্থী রয়েছেন ১০৬ জন। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ৯০ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১১ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫ জন কোটিপতি।উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন এ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। সেখানে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর ইকরামুল হক ও ডেটা ভিজুয়ালাইজেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর কেএম রফিকুল আলম। হলফনামা বিশ্লেষণের তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ডেটা ভিজুয়ালাইজেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর রিফাত রহমান।
টিআইবি বলেছে, প্রার্থীদের হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, এর ভিত্তিতে কোটিপতির হিসাব করা হয়েছে। ভূমির মতো স্থাবর সম্পদের মূল্য নির্ধারণ কঠিন হওয়ায় তা কোটিপতির হিসাবে আনা হয়নি।টিআইবির বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়, তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৬৬ দশমিক ৫৩ শতাংশই নিজেকে ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পেশা হিসাবে দেখিয়েছেন কৃষিকাজ। পেশার ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন আইন পেশা (৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ) ও শিক্ষকতা (৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ)।একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদেরও ৬৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ নিজেদের ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৪৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ গৃহিণী। গৃহস্থালির কাজকে তারা পেশা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তাদের প্রায় ৩২ শতাংশ পেশায় ব্যবসায়ী।
প্রসঙ্গত, ২১ মে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ৭১ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি ছিলেন ১০৫ জন। এর আগে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় না মুনাফা করার উদ্দেশ্যে আসছেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। তথ্য বলছে, জনপ্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতায় থাকলে অনেকের আয় ও সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ফলে জনস্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে না। টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছে। অন্যদিকে কৃষিজীবী ও শিক্ষকতায় যুক্ত প্রার্থীদের সংখ্যা কমছে।টিআইবি বলছে, এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যদের স্বজনদের অংশগ্রহণ থামাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপেও মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যদের ১৮ স্বজন অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে কুমিল্লার মুরাদনগরের সংসদ-সদস্য জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ছেলে আহসানুল আলম, নওগাঁর রাণীনগরের সংসদ-সদস্য আনোয়ার হোসেনের ছেলে রাহিদ সরদার এবং নরসিংদীর শিবপুরের সংসদ-সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লার স্ত্রী ফেরদৌসী ইসলাম চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। এর আগে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপেও মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যদের ১৭ স্বজন অংশ নেন।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে বুধবার দেশের ৯০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে। যদিও দ্বিতীয় ধাপে ১১২টি উপজেলায় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় সব পদে একক প্রার্থী থাকায় ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। দুটি উপজেলায় ভোট আগে স্থগিত করা হয়। আর ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে ১৯টি উপজেলায় ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
টিআইবির বিশ্লেষণে বলা হয়, জমির মালিকানার দিক দিয়ে আইনি সীমা অতিক্রম করেছেন ৬ জন প্রার্থী। আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর জমির মালিক হতে পারেন। টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দেওয়ান আশিদ রাজা চৌধুরীর মোট জমির পরিমাণ ২৮০ একর। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের রেজাউল করিমের জমির পরিমাণ ২৬৭ দশমিক শূন্য ৬ একর। নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার রাহিদ সরদারের জমির পরিমাণ ৬৫ দশমিক ৩৬ একর।
বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়, প্রার্থীদের মধ্যে অস্থাবর সম্পদের তালিকার শীর্ষে আছেন নরসিংদীর শিবপুরের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফেরদৌসী ইসলাম। তার মোট অস্থাবর সম্পদ ১৭৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। তিনি সংসদ-সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লার স্ত্রী।
তালিকার ২ নম্বরে আছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর জাহেদুল হক, তার সম্পদ ৩১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। তৃতীয় অবস্থানে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার প্রার্থী মোখলেছুর রহমান। তার অস্থাবর সম্পদের মূল্য ১৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।আয় বেশি বেড়েছে কক্সবাজারের নুরুল আলমের : ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে সবার ওপরে কক্সবাজারের টেকনাফের চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল আলমের। তার আয় বেড়েছে ১০৪ গুণ। ১০ গুণের বেশি আয় বেড়েছে আরও ৫ প্রার্থীর। তাদের দুজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান এবং তিনজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী।
সম্পদ বেশি বেড়েছে দেলদুয়ারের মাহমুদুলের : অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় সবচেয়ে বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসানের। তার সম্পদ বেড়েছে সাড়ে ৯৮ গুণ। ১০ গুণের বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে আরও ৯ জন চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর।
জবাবদিহি নিশ্চিত করছে না : ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈধভাবে আয় বাড়বে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে অস্বাভাবিকভাবে আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অস্বাভাবিক আয় বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কালোটাকা বৈধ করার সুযোগ দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনে নেই। এর মধ্য দিয়ে সরকার জনগণকে বার্তা দিচ্ছে আপনারা চুরি করেন, দুর্নীতি করেন, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেন। বছর শেষে আমাদের কাছে আসেন, আমরা ক্লিন সার্টিফিকেট দিয়ে দেব। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিকে উৎসাহিত ও অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।