সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই বলে যারা উৎখাতের স্বপ্ন দেখে
মোহাম্মাদ নাসির উদ্দীন:সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই বলে যারা উৎখাতের স্বপ্ন দেখে, তাদের পায়ের নিচে মাটি আছে কি না-সেই প্রশ্ন রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যারা সরকারের পায়ের নিচে মাটি খোঁজে, তাদের পায়ের নিচে মাটি আছে কি না, সেটি সন্দেহ। এখনো শুনি সরকার নাকি উৎখাত করে ফেলবে। এরা লম্বা লম্বা কথা বলে, আমাদের পায়ের নিচে নাকি মাটিই নেই। শুধু বিপ্লব করবে! বিপ্লব করতে করতে এরা ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে।বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে-এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। এ দেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আগে বিদেশের মানুষ বাংলাদেশের নাম শুনলে বলত-ভিক্ষা করে খায়, সাহায্য নিয়ে চলে। নেতিবাচক একটা ধারণা ছিল। আমার খুব কষ্ট হতো। কেন আমাদের অবহেলার চোখে দেখবে। দেশের ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে যাতে বিশ্ববাসী সম্মানের চোখে দেখে, সেই উদ্যোগে এগিয়েছি। এখন বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে বারবার ক্ষমতায় এসেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ যে বারবার ক্ষমতায় আসবে, এটা কখনো কেউ ভাবতে পারেনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। জনগণের ভোটেই বারবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি করে না, উন্নয়ন করে জবাব দেয়।
বাংলাদেশের জনগণই আমাদের শক্তি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস-এসবের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে সাক্ষী দিতে হবে যাতে তাদের সাজা হয়, এর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এদের কিন্তু ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, এরা দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। এরা আমাদের স্বাধীনতার শত্রু, এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু। তিনি বলেন, প্রথমে তারা নির্বাচন ঠেকাবে, নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। তাদের প্রভুরা আছে, তাদেরও চেষ্টা ছিল; কিন্তু তারা সেটা পারেনি। কারণ, বাংলাদেশের জনগণই আমাদের শক্তি। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের যত নির্বাচন হয়েছে, সব থেকে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন এবারই হয়েছে। আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রেখেছে, আমাদের ভোট দিয়েছে, আমরা সরকারে এসেছি।
শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে দেশের উন্নতি হয় : শেখ হাসিনা বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, কেউ যেন মাদক, অগ্নিসন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং কোনো রকম অপকর্ম করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালোভাবে আমরা মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস এগুলো চাই না। আমরা চাই, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক। কারণ, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে দেশের উন্নতি হয়। তিনি বলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। তাদের সন্ত্রাসের শিকার আমাদের নেতাকর্মীরা। আমরা কখনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না। আমরা তাদের অপকর্মের জবাব দিই দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে। সেটাই কিন্তু আমরা দিয়ে যাচ্ছি। যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের আমরা মূল্যায়ন করি।
কেউ পেছনে পড়লে টেনে তোলার দায়িত্ব আজকের এই নেতৃত্বের : নারীর ক্ষমতায়নে তার সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রযাত্রা চলছে। মেয়েদের যেখানে দিই, তারা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে। একটা সময় ছিল, মা-বাবা মেয়েদের বেশি পড়াতে চাইতেন না। এখন মেয়েরা সব ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা দেখাচ্ছে। নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করলে দেশ এগিয়ে যাবে। মেয়েদের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস-শিক্ষাদীক্ষায় তারা উন্নত হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে দলের ৪৮টি আসনের জন্য ১৫৪৯ জনের মনোনয়ন ফরম তোলাকে নারীজাগরণ বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অনেকে জানেন পাবেন না, তারপরও কেনা মানে যোগ্যতা জানান দেওয়া। সবাই-ই যোগ্য। তবে কঠিন একটা কাজ আমাদের ওপর পড়ল। এখনো যদি কেউ পেছনে পড়ে থাকে, তাদের টেনে তোলার দায়িত্ব আজকের এই নেতৃত্বের।
কেউ জায়গা করে দেয় না, জায়গা করে নিতে হয় : নারী নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংগঠন করতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কেউ জায়গা করে দেয় না, জায়গা করে নিতে হয়। তৃণমূলে গিয়ে জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। যারা মনোনয়ন পাবে না, তাদের নিজেকে আরও তৈরি করার পরামর্শ দেন তিনি। পরে প্রতিটি বিভাগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে পরিচিত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, এত মনোনয়নপ্রত্যাশী থেকে মনোনয়ন বাছাই করা, এটা একটা কঠিন কাজ। প্রতিটি বিভাগ থেকেই নিতে হবে। বহু নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলে তাদের সংসদে নিয়ে এসেছি। সংগঠনটা করতে হবে। কাজ করতে হবে।
এবার না হলে আগামী দিনে হবে : নির্বাচনে কেউ মনোনয়ন পাবে, কেউ পাবে না-এজন্য মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এবার না হলে আগামী দিনে হবে। একবার না পারিলে দেখ শতবার। তিনি বলেন, কতজনের বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। পঁচাত্তরের পর কী নিদারুণ কষ্টে তাদের জীবন পার করতে হয়েছে, সেটা আমি জানি। আমাকে সেসব খবরও নিতে হয়। বহু পরিবারের মেয়েদের আমি তুলে এনেছি। তারা হারিয়ে যাচ্ছিল রাজনীতি থেকে। হারিয়ে যাচ্ছিল ইতিহাস থেকে। অথচ তারা কত কষ্ট, জেলজুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে এদেশ স্বাধীন করে, তারপরও তারা কিন্তু কিছু পায়নি। কারণ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আজ সুযোগ এসেছে। কাজেই আমি তাদের মূল্যায়ন করি।
আমার যাত্রাপথ এত সহজ ছিল না : গণতান্ত্রিক ধারায় রাষ্ট্রপরিচালনা করার কারণে জনগণ বারবার ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, একটা রাষ্ট্র চালাতে গেলে অনেক মেধাবী লোকের দরকার হয়। আমাদের যারা মেধাবী, তাদের মেধার স্বাক্ষর রেখে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ সময় ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত বলে নিজের প্রত্যয়ের কথা জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ইতিহাস মুছে দিয়ে বিকৃত ইতিহাস প্রচার করা হতো। বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা আর বিকৃত ইতিহাস প্রচার করা হয়েছিল। কবরের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম-স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে দেব না। স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে পারে না। আমার যাত্রাপথ এত সহজ ছিল না। নানা ধরনের চক্রান্ত ছিল। মা-বাবা যেভাবে জীবন দিয়েছেন-দেশের মানুষের ভাগ্য গড়তে প্রয়োজনে নিজের রক্ত ঢেলে দেব। অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে। সেগুলো সহ্য করে ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছি। আমাদের একমাত্র শক্তি ছিল মানুষের ভালোবাসা আর মানুষের জন্যই কাজ করা।
নেতাকর্মীরা জীবন দিয়ে বারবার আমাকে রক্ষা করেছে : শেখ হাসিনা বলেন, শেখ রাসেলকে হত্যা করেছিল এজন্য যে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে। কখনো গুলি, কখনো বোমা, কখনো গ্রেনেড, অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হয়েছে। নেতাকর্মীরা জীবন দিয়ে বারবার আমাকে রক্ষা করেছে। সব সময় তাদের জন্যই দোয়া করি। আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় আসবে, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার দিনের ‘ঝড়ঝাপ্টা’ থাকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, দুই চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল ভাইদের। আমি তো তাদের পাইনি, পেয়েছিলাম সারি সারি কবর। সে কবর ছুঁয়ে শপথ করেছিলাম-স্বাধীনতা ব্যর্থ হতে দেব না। আমার এ যাত্রাপথ সহজ ছিল না। নানানরকম ষড়যন্ত্র চলেছিল, এখনো রয়েছে।
আজ বসন্ত, গণভবন ফুলে ফুলে সজ্জিত : নারী প্রার্থীদের বসন্তের শুভেচ্ছা জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, আজ বসন্ত, আমার গণভবন ফুলে ফুলে সজ্জিত। গণভবনে আপনারা এসেছেন। আমার গণভবন ধন্য হয়েছে। এরপর তিনি নারী প্রার্থীদের বিভাগওয়ারি পরিচিতি করে দেন। প্রথমে রংপুর, এরপর রাজশাহী। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ, খুলনা, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের নারী আসনে সংসদ-সদস্য প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে স্লোগান দেন। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, আমি জানি সবাইকে হয়তো সংসদ-সদস্য বানাতে পারব না; কিন্তু অন্যান্য জায়গায় তাদের আমি বসানোর চেষ্টা করি যেমন: সংগঠন। তাদের জায়গা করে দিই।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনে মোট ১৫৪৯টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে আওয়ামী লীগ। এসব মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাইকেই ডাকা হয় গণভবনে। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের স্লিপ দেখিয়ে সকাল থেকেই গণভবনে প্রবেশ করেন তারা। গণভবন কমপ্লেক্সে প্রতিটি বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা করা হয়েছিল।