২৮ অক্টোবরের ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে
মোহাম্মাদ আরিফ হোসেন:গত ২৮ অক্টোবরের ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের জামিন সংক্রান্ত মামলার ৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এর আগে বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের স্বাক্ষরের পর এ রায় প্রকাশিত হয়।এর আগে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে জারি করা রুল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। গত ১০ জানুয়ারি বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। পরে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলো।রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘আমরা গুরুত্বের সঙ্গে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক বিবেচনা করেছি এবং রেকর্ডটি পর্যবেক্ষণ করেছি। মামলার নথি থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে বিচারিক আদালত সিডিটি দেখেছে এবং অভিযুক্ত আবেদনকারীর সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে এই মামলায়। তদুপরি, মামলাটি তদন্ত প্রক্রিয়ায় কোনও প্রভাব সৃষ্টি না করে এখনও তদন্তাধীন থাকায় আমরা বলতে পারি যে বিশেষ করে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা এবং ওই বাড়িতে জোরপূর্বক প্রবেশের অভিযোগগুলো সত্যিই অত্যন্ত গুরুতর। প্রধান বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের তিনটি অঙ্গের একটির প্রধান। তাই প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে আমরা মনে করি।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘‘আসামিপক্ষের আইনজীবী দাবি করেন যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে অনেক দূরে ছিলেন। কিন্তু ‘বরেন্দ্র কুমার ঘোষ এবং অন্যান্য’ মামলার (প্রিভি কাউন্সিল, ২৩ অক্টোবর ১৯৪২, যা পোস্ট অফিস কেস নামে পরিচিত) সিদ্ধান্ত যে একজন ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেওয়ার কারণে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারার অধীনে দায়বদ্ধ হতে পারে, এমনকি সেই প্ররোচনা দূরবর্তী স্থান থেকে হলেও। ‘মেজর মো. বজলুল হুদা (আর্টিলারি) এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র’ মামলার ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল। আমরা মনে করি যে একজন ব্যক্তি তার অনুসারীদের অনেক দূর থেকে আদেশ দিতে পারেন।হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘মামলার শুনানিতে মির্জা ফখরুলের আইনজীবীরা বলেছেন, আবেদনকারী অত্যন্ত অসুস্থ। এই দাবিটি আসামির বিরুদ্ধে যায় যে তিনি প্রধান অতিথি হিসাবে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন—যা একজন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের অবশ্যই তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত না করে বলতে হবে যে তার জড়িত থাকার বিষয়ে কিছু অন্তর্নিহিত স্বীকারোক্তি রয়েছে।’
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘‘অভিযুক্ত আবেদনকারী (মির্জা ফখরুল) দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছেন, যাকে তিনি ‘জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন’ দাবি করে আসছেন। দুর্ভাগ্যবশত, বিগত কয়েক মাসে দেখা গেছে যে কথিত ওই ভোটাধিকারের দাবি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে যুক্ত হয়েছে। যাতে প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনকারী সরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহন, পুলিশের গাড়িতে হামলার মতো ঘটনা রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, কথিত আন্দোলনকারীরাই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এসব অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা বিবেচনায় নিয়েছি, যেগুলো দৃশ্যত দেশে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বস্তুত দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।আবেদনকারী বিপর্যয়কর ও উচ্ছৃঙ্খল এসব ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা তার কোনও ভূমিকা ছিল কিনা, সে বিষয়ে কেবল সুষ্ঠু তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তদন্তের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে এই পর্যায়ে তার মুক্তির জন্য জামিন দেওয়া সহায়ক হবে না বলে আমরা মনে করছি। মামলায় কিছু ধারা আছে জামিন অযোগ্য। প্রজাতন্ত্র ও জনগণের নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা রুলটি খারিজ করছি। তবে আবেদনকারী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোনও অসুস্থতায় ভুগলে তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমরা কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিচ্ছি।উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ অক্টোবরের রাজধানীর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ চলাকালে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। ওই মামলায় মির্জা ফখরুল ছাড়াও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ ৫৯ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।
ফখরুল-আব্বাস ছাড়াও মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন—বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, আহমেদ খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, ভিপি জয়নাল, মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ফরহাদ হালিম ডোনার ও সদস্য সচিব আমিনুল হক।পরে গত ৩ ডিসেম্বর এই মামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। তার আগে গত ২২ নভেম্বর তার জামিন নামঞ্জুর করেন অধস্তন আদালত। এছাড়া গত ২ নভেম্বর একই আদালতে জামিন আবেদন দাখিল করেন মির্জা ফখরুলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ।ওই মামলায় গত ৭ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কেন জামিন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। তবে শুনানি শেষে সে রুল খারিজ হওয়ায় হাইকোর্টে জামিন মেলেনি মির্জা ফখরুলের।