প্রাণ গেছে ৫০২৪ জনের ৫৪৯৫ দুর্ঘটনায়
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের সংখ্যা নিয়ে প্রথমবারের মতো বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, বিদায়ি ২০২৩ সালে সারা দেশে পাঁচ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ২৪ জন নিহত ও সাত হাজার ৪৯৫ জন আহত হয়েছেন। এই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এক বছরে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত যানবাহনের সংখ্যা সাত হাজার ৮৩৭টি। এর মধ্যে এক হাজার ৭৪৭টি মোটরসাইকেল; যা মোট আক্রান্ত যানবাহনের ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএর সদর দপ্তরে সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার এ তথ্য জানান।প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে বিআরটিএতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নুর মোহাম্মদ মজুমদার বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানকে অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যও অবাস্তব বলে জানান তিনি।অপরদিকে সেতু ভবনে প্রেস ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের ডব্লিউএইচও ও যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ডব্লিউএইচও এর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ হাজারের বেশি মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেছিল। আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম ওই তথ্য সঠিক নয়। ওই চ্যালেঞ্জের যথাযথ উত্তর পাইনি। এ সময় বিআরটির তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ডব্লিউএইচও ওখানে বসে বসে এ তালিকা কই পেল। ওই সংস্থাকে তথ্য দেওয়া বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির কোনো নিবন্ধন নেই বলেও জানান তিনি।
সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে ইজিবাইক, নসিমন, করিমনের পাশাপাশি মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেওয়ার কথা জানান সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে একটা জিনিস উপেক্ষা করতে পারি না। এখানে যেভাবে তিন চাকার গাড়িগুলো চলছে। ইজিবাইকসহ এই গাড়িগুলোর কারণে বেশিরভাগ অ্যাক্সিডেন্টগুলো হচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে মোটরসাইকেলে। আমি মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক নিয়ে, বিশেষ করে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি নিয়ে একটা নীতিমালা করার জন্য সচিবকে নির্দেশ দিয়েছি। এর আগে কিছুটা কাজ হচ্ছিল নীতিমালা নিয়ে। এই নীতিমালার কাজ যেন দ্রুত শেষ হয় সেই নির্দেশ দিয়েছি।অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই নীতিমালা কার্যকর করতে হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক রোড সেফটির ওপরে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমি আশা করি এই দুটি কাজ হয়ে গেলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। বারবার বলার পরও কেন তিন চাকার বাহন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না, স্থানীয় সংসদ-সদস্যরা কী ভূমিকা রাখছেন-এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, এখানে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনেরও দায়িত্ব আছে। তা ছাড়া আমাদের হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা কম, এখানে জনবলেরও একটা ব্যাপার আছে।
এদিকে বিআরটিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৫৬৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৩৩ জন মারা গেছেন। জুনে সড়কে ৫৬২টি দুর্ঘটনায় ৫০৪ জন নিহত হন। সর্বশেষ ডিসেম্বরে ৪৮৩টি দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৬৪১ জন।এতে আরও বলা হয়েছে, বিদায়ি বছরে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ৭৮৭টি মোটরযানের মধ্যে মোটরসাইকেল এক হাজার ৭৪৭টি (২২.২৯ শতাংশ), বাস বা মিনিবাস এক হাজার ৮৩টি (১৩.৮২ শতাংশ), ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান এক হাজার ৩৮৯টি (১৭.৭২ শতাংশ), অটোরিকশা ৪৯৭টি (৬.৩৪ শতাংশ) এবং বাকি সব অন্যান্য যানবাহন।
বছরে বছরে দুর্ঘটনায় হতাহত বাড়ছে : বিআরটিএ জানিয়েছে, গত এক বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যান তৈরি করছে এ সংস্থাটি। এর আগ থেকে পুলিশ হতাহতের তথ্য নিয়ে আসছে। ২০২৩ সালে বিআরটিএর প্রতিবেদনে ৫৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০২৪ জন মারা গেছেন। একই সময়ে পুলিশের প্রতিবেদনে ৫০৯৩টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৪৭৫ জন। এর আগে ২০২২ সালে পুলিশের তথ্যমতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৬৩৬ জন মারা গেছেন। ২০২১ সালে ৫০৮৪ জন, ২০২০ সালে ৩৯১৮ জন ও ২০২০ সালে ৩৯১৮ জন মারা গেছেন।
বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান : সংবাদ সম্মেলনে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সেগুলো অবাস্তব পরিসংখ্যান। নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির রিপোর্ট অতিরঞ্জিত। এতে তাদের প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এস্টিমেটেড মৃত্যুর সংখ্যা ৩১ হাজার ৫৭৮ রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করে এস্টিমেটেড তথ্য প্রকাশ করেছে, যার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার মিল পাওয়া যায় না। পাশাপাশি এই মডেল সব দেশের জন্য এক নয়। সব দেশের দুর্ঘটনার মৃত্যুর সংখ্যা অনুমানের জন্য ডব্লিউএইচও একমাত্র কম্পিউটারনির্ভর রিগ্রেশন মডেল ব্যবহার করেছে যার মাধ্যমে এতগুলো দেশের সড়ক দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্র উঠে আসে না।
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ১৯৪ জন : বিআরটিএর চেয়ারম্যান জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় ১৯৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড। যার আর্থিক পরিমাণ আট কোটি ৫৬ লাখ টাকা। মঙ্গলবার পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ৮৭৯টি। এর মধ্যে অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হয়েছে ৭৯৪টি। অনুসন্ধান কমিটি ২৭৩টি আবেদনের ওপর প্রতিবেদন দিয়েছে।