ড. ইউনূসের ছয় মাসের সাজা, আপিলের শর্তে জামিন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ড. ইউনূসের ছয় মাসের সাজা, আপিলের শর্তে জামিন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা


মোহাম্মাদ আরিফ হোসেন:শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে দুটি ধারায় ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ২৫ দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সোমবার দুপুরে ঢাকার শ্রম আদালত-৩-এর বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে ড. ইউনূসসহ চার আসামির উপস্থিতিতে বিচারক ৮৪ পৃষ্ঠার এ রায় ঘোষণা শুরু করেন। সাজার রায় ঘোষণার পর ড. ইউনূসসহ দণ্ডিত চারজনের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার শর্তে জামিনের আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। পরে আদালত আপিলের শর্তে ৫ হাজার টাকা বন্ডে ১ মাসের জামিন মঞ্জুর করেন। অর্থাৎ এক মাসের মধ্যে তাদের শ্রম অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে হবে। এখনই কারাগারে যেতে হবে না ড. ইউনূসকে।এ মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামি হলেন গ্রামীণ টেলিকমের এমডি মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক নূরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এক নম্বর আসামির বিষয়ে প্রশংসাসূচক বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা নোবেলজয়ী আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছে। কিন্তু এ আদালতে নোবেলজয়ী ইউনূসের বিচার হচ্ছে না, গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসাবে তার বিচার হচ্ছে। ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ সময় ড. ইউনূসের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, তার স্ত্রী অ্যাক্টিভিস্ট রেহনুমা আহমেদ, রাজনীতিবিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট আসিফ নজরুলসহ দেশিবিদেশি পর্যবেক্ষকরা শ্রম আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রায় ঘিরে আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার : রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শ্রম আদালত ও আদালত চত্বরের আশপাশে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয় এবং বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।আদালত চত্বরের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিল বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের মামলায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রায়কে ঘিরে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে, সেজন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সাইবার মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। মোতায়েনকৃত পুলিশ সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম-ড. ইউনূস : রায় ঘোষণার পর নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, যে দোষ আমরা করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম। এটা আমাদের কপালে ছিল, জাতির কপালে ছিল, আমরা সেটা বহন করলাম। রায় ঘোষণা শুনতে আমার অনেক বিদেশি বন্ধুবান্ধব এসেছেন। যাদের সঙ্গে বহুদিন দেখা হয়নি। আজ তাদের দেখে খুব আনন্দ লাগছিল। সবাই রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যে দোষ আমরা করিনি, সে দোষে সাজা দেওয়া হলো। আনন্দের দিনে আঘাতটা পেলাম।

ন্যায়বিচার হয়েছে কি না সন্দেহ আছে-ড. আসিফ নজরুল : রায়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা এখানে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এসেছি স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের বিচার চলাকালে এবং এর আগে ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ওনার বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা হয়েছে। যেভাবে শ্রম আদালত বসেছে, অস্বাভাবিক ঘনঘন শুনানি হয়েছে, অস্বাভাবিক দ্রুততায় রায় হয়েছে। এটা ন্যায়বিচার হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে এবং বাংলাদেশের মানুষের স্যারের প্রতি যে ভালোবাসা আছে, সেটার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, এটাকে আদালত মনে হয়নি। এটাকে নির্যাতন করার একটা পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনকে ব্যবহার করে একজন মানুষকে নির্যাতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এ সরকার যদি সত্যিকার অর্থে আইনের ব্যাপারে সচেতন থাকত, তাহলে শ্রমিকদের ভালোবাসত, লাখ লাখ শ্রমিকের ন্যায্য বেতন দিতে রাজি থাকত। এরকম জায়গায় ভুয়া একটা মামলা দিয়ে একজন নিরীহ ব্যক্তিকে অত্যাচার করার কোনো যুক্তি নেই।আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি-আসামিপক্ষের আইনজীবী : ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা বিক্ষুব্ধ, এ রায় অন্যায় ও আইনবিরোধী। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। রাষ্ট্রপক্ষ কোনো কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আপিল কোর্টে আমরা এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইব।

তিনি বলেন, আমরা এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ। লেবার কোর্টের ইতিহাসে এত তাড়াতাড়ি ড. ইউনূসের মামলার শুনানির জন্য ১০টি ডেট দেওয়া হয়েছে। নিজেরা তড়িঘড়ি, ইতিহাস ব্রেক করে, সাড়ে ৮টা পর্যন্ত শুনানি করে আজকের এ রায় ঘোষণা করা হয়েছে।নোবেল বিজয়ী হলেই তো আইনের ঊর্ধ্বে না-বাদীপক্ষের আইনজীবী : রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর পক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, সন্দেহাতীতভাবে আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে তারা শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন। বাদীপক্ষের চারজন সাক্ষী ও কিছু ডকুমেন্টের মাধ্যমে প্রমাণও করেছি।

প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসাবে তার বিচার হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নোবেল বিজয়ী হিসাবে নয়, প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসাবে তার বিচার হয়েছে। আমরা প্রথম দিনে জেরায় বলেছি। এখানে কিন্তু বিষয়টা নোবেল বিজয়ী না। আমরা কলকারখানা পরিদর্শনের ক্ষেত্রে কাগজেকলমে কোনো ডকুমেন্টসে নোবেল বিজয়ী হিসাবে তাকে দেখিনি। তাকে আমরা দেখেছি প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসাবে। শ্রম আইন লঙ্ঘন করার অপরাধে তার বিচার হচ্ছে। আমাদের সেই যুক্তিটা আদালত অ্যাকসেপ্ট করেছেন।খুরশীদ আলম খান বলেন, আমরা কোনো কিছু বললেই তারা বলেন নোবেল বিজয়ী। নোবেল বিজয় হলেই তো আইনের ঊর্ধ্বে না। তিনি হতে পারেন নোবেল বিজয়ী। এটা তার ব্যক্তিগত অর্জন। প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসাবে তিনি যে শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেটি আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি। এক্ষেত্রে আমরা একবারও বলিনি যে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে শাস্তি দেওয়া হোক। এ ধরনের কথা আমরা কখনোই বলিনি। বরং তারা ড. ইউনূসকে নোবেল বিজয়ী বলেই সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন। সরকারের পক্ষে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান ও পরিদর্শন অধিদপ্তর নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে হয়রানি করছে এবং সে উদ্দেশ্যে মামলাটি করা হয়েছে-এমন অভিযোগ আমরা বারবার অস্বীকার করেছি। আজ আদালতের পর্যবেক্ষণেও এসেছে যে, আজকে যার রায় হলো, সেটি কোনো নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে না। শ্রম আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে।

রায় চলাকালীন ড. ইউনূসের পক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বারবার ডিসপিউট দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, রায় চলাকালীন আদালতকে বারবার বিরক্ত করা, এটা আমি আগে কখনো দেখিনি। আমরা সুপ্রিমকোর্ট, আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ এমনকি বিচারিক আদালতে যখন রায়ের জন্য দিন ধার্য থাকে, সেদিন বসে থাকি। আর আদালতের রায়টা রিসিভ করি। আমরা অত্যন্ত লজ্জিত, লজ্জা পাচ্ছি, একজন আইনজীবী তার মক্কেলের জন্য বারবার আদালতকে ডিস্টার্ব করছিলেন। আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন, আদালত কিন্তু তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এরই মধ্যে রায় হয়ে গেছে। রায় হওয়ার পরে উনি কীভাবে বলতে পারেন, আমার এটা নিতে হবে, ওটা নিতে হবে। এটা তো আদালতের ডিসিশন, আদালত কোনটা নেবে কি নেবে না। এক্ষেত্রে বারবার আদালতকে ইন্টারফেয়ার করা বিচারিক অশোভনীয়।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায় : এ মামলায় ৬ জুন ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। অভিযোগ গঠনের আদেশ বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছিলেন ড. ইউনূস ও অন্যরা। আপিল বিভাগ ২০ আগস্ট সেই আবেদন চূড়ান্তভাবে খারিজ করে দেন। এরপর ২২ আগস্ট শ্রম আদালতে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় ৯ নভেম্বর। এতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চারজন কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেন।

২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ আনা হয়-শ্রম আইন, ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি দেওয়া, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয় না, গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয় না।

Top