সরকার পতনের একদফা দাবি আদায় ছাড়া রাজপথ ছাড়বে না বিএনপি
মোহাম্মদ আরিফ হোসেন : সরকার পতনের একদফা দাবি আদায় ছাড়া রাজপথ ছাড়বে না বিএনপি। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর হরতাল-অবরোধ থেকে বের হয়ে আসার কথা ভাবছে দলটি। ভিন্ন কর্মসূচি হিসাবে বিক্ষোভ সমাবেশ, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে জমায়েত কিংবা নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভবন ঘেরাও কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে নীতিনির্ধারকদের। কেউ কেউ হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির মাঝে বিরতির মধ্যে এসব কর্মসূচি পালনের পক্ষে। আবার কেউ হরতাল-অবরোধ থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প এসব কর্মসূচি পালনের পরামর্শ দিয়েছেন। তবে কোনো কারণে পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে এলে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতেই থাকবে এমন আলোচনাও আছে। চূড়ান্ত আন্দোলনের এক মাসের পর্যবেক্ষণসহ নতুন কর্মসূচি ঠিক করতে আগামীকাল সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করার কথা রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের।এছাড়া বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, গণগ্রেফতার, হয়রানি আর দ্রব্যমূল্যের ইস্যু কাজে লাগাতে চাইছে দলের হাইকমান্ড। রাজপথের আন্দোলন-বিরতির মধ্যে মাঠে নামানো হবে বিভিন্ন পেশাজীবী, নারী সংগঠনসহ গুম-খুন ও কারা নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের। আজ রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাজা ও কারাবন্দি নেতাদের পরিবারের সদস্যদের ‘প্রতিবাদী মানববন্ধন’ কর্মসূচি রয়েছে। একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা ও নির্বাচনের বাইরে থাকা বাম-ডান ও ইসলামি দলগুলো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে আজ ইসলামী আন্দোলনের ডাকা ‘জাতীয় সংলাপ’ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন দলটির দুই সিনিয়র নেতা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন ধরনের কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা আলোচনা করছেন।বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার আগে আন্দোলনের একটি পর্ব শেষ হবে। এরপর আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের দিনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের আরেকটি পর্ব শুরু হবে। মনোনয়নপত্র জমার পর থেকে ভোটের দিনের মধ্যকার সময়ে বিক্ষোভ, পদযাত্রা ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির মধ্যে থাকা নিয়ে আলোচনা চলছে। পরিস্থিতি বুঝে ফাঁকে ফাঁকে হরতালও দেওয়া হতে পারে।তবে কোনো কারণে পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে এলে ‘অসহযোগ’ নাম দিয়ে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতেই থাকবে।এদিকে আজ ভোর ৬টায় সপ্তম দফার অবরোধ শেষ হয়। আগামীকাল বুধবার ভোর ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি আবারও পালন করবে বিএনপিসহ সমমনারা। এছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালেরও ডাক দিয়েছেন তারা।
স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে নেতারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বাপর পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। নেতারা মনে করেন, হরতাল-অবরোধে জনগণের সমর্থন থাকলেও টানা কর্মসূচিতে সবার মধ্যে একঘেয়েমি তৈরি হচ্ছে। নেতাকর্মীদের মধ্যেও শৈথিল্য এসে গেছে। সেজন্যই বিকল্প কর্মসূচি, কিন্তু তা কঠোর হবে-এমনটা ভাবা হচ্ছে। তবে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে বের হওয়া কঠিন বলেও মনে করেন অনেক নেতা। তাদের মতে, কঠোর কর্মসূচি থেকে আবার বিক্ষোভ বা ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিতে গেলে তৃণমূলের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। তারা (তৃণমূল) এটিকে এক ধরনের পরাজয় হিসাবেও ভাবতে পারে। সেক্ষেত্রে সবার আগে তৃণমূলের পরামর্শও বিবেচনায় নিতে হবে।
চাপ সত্ত্বেও দল ছাড়ছেন না নেতারা : বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভোটে অংশ নিতে নানা প্রলোভন দেখালেও তাতে সফল হয়নি সরকার। বিএনপির সাবেক নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভোটে যেতে ফোন পর্যন্ত করা হচ্ছে। বিএনপিপন্থি কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতাকেও ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি। নেতাদের মতে, সরকার ছোট ছোট দলকেও নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন পর্যন্ত কয়েকটি দল ছাড়া বেশির ভাগ দল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার বিষয়ে সাড়া দেয়নি। এটিকে নিঃসন্দেহে প্রাথমিক জয় হিসাবে দেখছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে কারও আগ্রহ নেই। তার পরও জোরজবরদস্তি এবং নানা প্রলোভন দেখিয়ে নির্বাচনের মাঠে ছোট ছোট দলকে টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতেও সরকার সফল হয়নি। তিনি বলেন, রাজনীতির মাঠে কিছু বেইমান সব সময় থাকে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যারা বেইমানি করেছেন, তারা সফল হতে পারেননি। নিকট অতীতের এই শিক্ষা সবার মাথায় রাখা উচিত। দলের কোনো নেতাকেই তারা ভোটে নিতে পারবে না বলেও তার বিশ্বাস।
আজ সাজা ও কারাবন্দি নেতাদের পরিবারের মানববন্ধন : আজ সকাল ১১টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাজা ও কারাবন্দি নেতাদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিবাদী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন। জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাব হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহান ও শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আতাউর রহমান ঢালী ও হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, আসলাম চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কদ্দুস তালুকদার দুলু, বিলকিস জাহান শিরিন, সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্স, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ কেন্দ্রীয় ও জেলার যেসব নেতার সাজা হয়েছে এবং কারাবন্দি আছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা এ মানববন্ধনে অংশ নেবেন।
আবারও কাল অবরোধ ও বৃহস্পতিবার হরতালের ডাক : সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবি এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে আগামীকাল বুধবার ভোর ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথ অবরোধ করবে বিএনপি। এছাড়াও বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালেরও কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। একই কর্মসূচি পালন করবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপিসহ সমমনারা। যুগপৎ আন্দোলন না থাকলেও একই কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও।