ফের মামলার খড়্গে পড়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : মহাসমাবেশ ও হরতাল-এই দুদিনের কর্মসূচি ঘিরে ফের মামলার খড়্গে পড়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এবার ৪২২টি মামলায় দলটির ৩১ হাজার ৯৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গ্রেফতার হয়েছেন ৫ হাজার ৩১০ জন। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশের বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেখা মিলছে না কেন্দ্রের শীর্ষ নেতাদের। অব্যাহত আছে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান। গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলনসহ জরুরি বৈঠক করছেন অনলাইনে। দলটির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। এসব মামলা ও গ্রেফতারের বিষয়ে সরকারের কোনো সূত্র এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়নি। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছ থেকে আংশিক তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায়, বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় রাজধানীতে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ৫৪৪ জনকে। ২১ থেকে ২৯ অক্টোবর রোববার পর্যন্ত ঢাকায় গ্রেফতার হয়েছেন ১ হাজার ৭২৭ জন।বিএনপির দাবি-গত ১৫ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এক লাখের বেশি। এতে আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সরকারের একটা বড় অস্ত্র গায়েবি মামলা। আগে যেভাবে গায়েবি ভোট ছিল, সেভাবে গায়েবি মামলা শুরু হয়েছে জোরেশোরে। হজে থাকা অবস্থায় মানুষ পুলিশকে মারধর করে, মারা গেছে, কবরে আছে এসব লোক এসে নাশকতার পরিকল্পনা করে।এসব মামলা দিয়ে সরকার নিজেদের গায়েব হয়ে যাওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি করছে। এক সময় তারা নিজেরাই গায়েব হয়ে যাবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে এই অবৈধ সরকার আসলে ভীত হয়ে পড়েছে। এজন্যই আবারও মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিতে শুরু করেছে। এ দিয়ে বিএনপিকে দমন করা বা হটানো যাবে না।
এদিকে ব্যুরো, জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ঢাকার বাইরের ২৮টি মামলার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, বিএনপির হরতাল চলাকালে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর-আগুন ও সড়কে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে মামলা হয়েছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এই ২৮ মামলায় ২২৮০ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত এসব জেলায় বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে।শনিবার দুপুরের আগে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বনির্ধারিত মহাসমাবেশ ছিল। এটি শুরুর আগেই কাকরাইল মোড়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় দলটির নেতাকর্মীদের।
পরে শান্তিনগর, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ এবং দৈনিক বাংলা মোড়সহ আশপাশের এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সহিংসতার এ ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়। ঢাকার মামলার এজাহারগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ মামলার আসামিই বিএনপির পদধারী নেতা। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বড় একটি অংশের নামও এসব মামলার এজাহারে রয়েছে। এদের মধ্যে আছেন-বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি এখন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। আসামিদের মধ্যে আরও আছেন-বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রুহুল কবির রিজভী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, বরকতউল্লা বুলুসহ অনেক শীর্ষ নেতা।
ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার কেএন রায় নিয়তি জানান, গত ২৮ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সহিংসতার ঘটনায় এসব মামলা হয়। এজাহারভুক্ত ১ হাজার ৫৪৪ জন আসামির বাইরেও এতে অজ্ঞাতনামা অনেক আসামি রয়েছেন।ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, এজাহারনামীয় আসামির বাইরে এই ৩৭টি মামলায় ৫ হাজার ২০৭ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলায় সবাই অজ্ঞাতনামা আসামি। এই সংখ্যা ১ হাজার ৪০৭ জন। এর মধ্যে ২৯ অক্টোবর তারিখে মতিঝিল থানার ২৩ ও ২৪নং মামলায় ২০০ জন, শাহজাহানপুর থানার ২৫, ২৬ ও ২৭নং মামলায় ৪০৭ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া ৩০ অক্টোবর মিরপুরের পল্লবী থানার ৫৮নং মামলায় ৫০০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি। ডিএমপি আরও জানায়, সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত ৯ দিনে ঢাকা থেকে মোট ১ হাজার ৭৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ অক্টোবর ৩১ জন, ২২ অক্টোবর ৪২ জন, ২৩ অক্টোবর ৪২ জন, ২৪ তারিখ ৮৫ জন, ২৫ তারিখ ১১১ জন, ২৬ তারিখ ২০২ জন, ২৭ তারিখ ৩৪০, ২৮ তারিখ ৬৯৬ এবং ২৯ তারিখ ২৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৩৭টি মামলার মধ্যে রমনা থানায় ২টি, শাহবাগ থানায় একটি, মতিঝিল থানায় একটি, পল্টন থানায় তিনটি, শাহজাহানপুর থানায় ৬টি, খিলগাঁও থানায় একটি, রামপুরা থানায় একটি, মুগদা থানায় একটি, ওয়ারী থানায় একটি, যাত্রাবাড়ী থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এছাড়া হাতিরঝিল থানায় একটি, কাফরুল থানায় একটি, দারুসসালাম থানায় একটি, শাহআলী থানায় একটি, রূপনগর থানায় একটি, ভাষানটেক থানায় একটি, পল্লবী থানায় দুটি, ভাটারা থানায় তিনটি, উত্তরা পূর্ব থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। এর বাইরে ডেমরা থানায় একটি, হাতিরঝিল থানায় একটি, মিরপুর মডেল থানায় একটি ও বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়।
এদিকে বিএনপির দেওয়া তথ্য যাচাই করতে সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর যুগান্তরকে জানান, এই মুহূর্তে ২৮ অক্টোবর ঘিরে মামলা ও গ্রেফতারের তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা মাসিক হিসাবে গ্রেফতারের তথ্য পান। চলতি মাস শেষে মামলা ও গ্রেফতারের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে।এদিকে মামলার অনেক আসামির অভিযোগ, কেবল বিএনপি করার কারণে ঘটনাস্থলে না থেকেও তারা আসামি হয়েছেন। অনেকে আবার বিএনপি ছেড়ে দিয়েও আসামি হয়েছেন। ঘটনাস্থলে না থেকেও এজাহারনামীয় আসামি হওয়ার অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। কারাগারে থেকেও মামলার আসামি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।গুলশানের সাহাব উদ্দিন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন অভিযোগ করেন, তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তিনি ও তার ছেলে ফয়সাল আল ইসলাম তাদের মেডিকেল কলেজে অবস্থান করছিলেন।