বিচারাধীন অবস্থায় বিশেষ শ্রেণির স্বার্থে এই আইন - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিচারাধীন অবস্থায় বিশেষ শ্রেণির স্বার্থে এই আইন


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার তদন্তকালে তাদের গ্রেফতার করা যাবে কি না-এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা এখনো বিচারাধীন। এ অবস্থায় আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার আগে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে মর্মে বিধান রেখে জাতীয় সংসদে যে আইন পাশ হয়েছে, এর তীব্র সমালোচনা করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। ফৌজদারি মামলার আসামি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও মামলার আসামি হিসাবে কাউকে গ্রেফতারে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতির বিধানটি বেআইনি। কারণ, বিষয়টি এখনো সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন।বিচারাধীন কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন কিংবা বাতিলের এখতিয়ার কারও নেই জানিয়ে তারা বলেন, সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার জন্য এ আইন পাশ করা হয়েছে।সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বুধবার বলেন, এ ধরনের আইন কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। আইন সবার জন্য সমান। বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দিয়ে কোনো আইন করা হলে দেশে বিবাদ বা বৈষম্য তৈরি হয়, যা উচিত নয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, এ বিষয়টি বারবার সামনে আসছে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন যখন সংশোধন করা হয়, তখন এটি যুক্ত করা হয়েছিল। ওই সময়ে বলা হয়েছিল, সরকারি চাকরিজীবীদের দুদক গ্রেফতার করতে চাইলে সরকারের অনুমতি লাগবে। কিন্তু হাইকোর্ট এটি বাতিল করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, সরকারি চাকরিজীবীরা সব সময় নিজেদের জন্য সুরক্ষা নিতে চান। আর রাজনীতিবিদরাও এসব কাজে তাদের সহায়তা দেন। কিন্তু এটি সংবিধানের সঙ্গে যায় না। কারণ, একই দেশে সাধারণ নাগরিকদের জন্য এক নিয়ম এবং সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আলাদা নিয়ম যৌক্তিক নয়। ফলে আমার মন্তব্য হলো, এবারও বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সামনে নির্বাচন। এ আইনের ফলে সরকারি কর্মচারীরা আরও সুযোগ পাবে। তিনি আরও বলেন, অনুমতি ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যাবে না মর্মে সরকারি চাকরি আইনের সংশোধন বিল পাশ হয়েছে। এর আগে পাঁচ শতাংশ বেতনভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটা দুর্বল গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের দেশে প্রচলিত পদক্ষেপ।

ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারের আগে অনুমতি নেওয়া ঔপনিবেশিক শাসনামলে ছিল। ব্রিটিশরা চলে গেছে। কিন্তু একটা বিশেষ শ্রেণির জন্য বিশেষ সুবিধা এখনো চালু আছে, এটা ঠিক না।দুর্নীতি দমন কমিশনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতারের আগে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নেওয়ার আইনের ধারাটি বাতিল করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার, যা এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আমার প্রশ্ন-সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি পেন্ডিং থাকা অবস্থায় কীভাবে তা পাশ করা হলো?

ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার আগে গ্রেফতারের প্রয়োজন হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেওয়ার বিধান করে সরকার। ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর পাশ হওয়া সরকারি চাকরি আইনে উল্লিখিত বিধান রাখা হয়, যা ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়। আইনটি কার্যকরের মাত্র ১৪ দিনের মাথায় ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিটপিটিশন করেন পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। দীর্ঘ শুনানির পর উচ্চ আদালত সরকারি চাকরি আইনের সেই ধারা বাতিল করে দেন।

হাইকোর্ট তখন বলেন, সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কিন্তু আইনে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারের আগে অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখায় একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধান কখনোই সমর্থন করে না। ফলে একটি গোষ্ঠীকে আইনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈষম্য সংবিধান ও আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে স্পষ্টতই বলে দেওয়া হয়েছে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি ও বৈষম্যমূলক যে কোনো আইন বাতিলযোগ্য। এ কারণে সরকারি কর্মচারীদের মামলায় গ্রেফতারের পূর্বানুমতির বিধান রেখে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারায় যে সুবিধা দেওয়া হয়, তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাতিল করা হলো। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিল আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে এবং আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মঙ্গলবার সরকারি চাকরি আইন ২০২৩ (সংশোধন) জাতীয় সংসদে পাশ হয়।

প্রসঙ্গত, সরকারি, স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে করা ফৌজদারি মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণের আগে তাদের গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নিতে হবে-এমন বিধান রেখে মঙ্গলবার সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল-২০২৩ জাতীয় সংসদে পাশ হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্বশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের বেতনভাতা, অবসর-সুবিধা আইনের আওতায় আনা হয়।

Top