মসজিদের জমির মালিক এখন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব ! ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ : তদন্ত করবে দুদক - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মসজিদের জমির মালিক এখন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব ! ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ : তদন্ত করবে দুদক


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :জমি লিখে নেওয়াসহ মসজিদের অন্তত ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে। সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান রাকিবুল আহসান ও তার স্ত্রী সুরাইয়া নাসরিনসহ আরও ৪ জনকে আসামি করা হয়েছে এই মামলায়।তাদের বিরুদ্ধেও আনা হয়েছে অবৈধ পন্থায় মসজিদের জমির মালিক হওয়া ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। বুধবার হওয়া মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ (ভারপ্রাপ্ত) একেএম এনামুল করিম। মাহবুব তালুকদার ও রাকিবুল আহসান অবশ্য এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি। রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য এই মামলা করা হয়েছে বলে দাবি তাদের।মামলার বাদী কলাপাড়ার খেপুপাড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদ কমিটির সদস্য আ. হান্নান বেপারী। মামলার অপর দুই আসামি হলেন কলাপাড়া উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ ও খেপুপাড়ার ভূমি অফিসের সাবরেজিস্ট্রার। মামলার অভিযোগে বাদী বলেন, পরপর ৩ বার সাবেক এমপি ও একবার পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে মসজিদের জমি নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়াসহ এর উন্নয়নে আসা সরকারি বরাদ্দের বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন। সে সময় কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র পদে থাকা রাকিবুল আহসানও একইভাবে নিজের এবং তার স্ত্রীর নামে মসজিদের জমি দলিল করে নেন। দুজনার যোগসাজশে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি চলাকালে এরা ছিলেন যথাক্রমে মসজিদের প্রধান উপদেষ্টা এবং পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক।২০১১ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এসব দুর্নীতি চললেও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হওয়ার কারণে এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। তারপরও ২০২০ সালের ২৮ মে এব্যাপারে প্রথম অভিযোগ দেওয়া হয় কলাপাড়া উপজেলার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। টানা ৭ মাস ১২ দিন অপেক্ষা করেও অভিযোগের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না দেখে ২১ সালের ৯ জানুয়ারি অভিযোগ জানানো হয় পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক এবং ওয়াকফ প্রশাসনের কাছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তৎকালীন ওয়াকফ প্রশাসন অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান জেলা প্রশাসক।

২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসন থেকে এই সংক্রান্ত চিঠি গেলেও আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে বাদী বাধ্য হয়ে আদালতে এই মামলা করলেন। তদন্ত এবং বর্ণনা অনুযায়ী মামলায় যে ৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে তাদের মধ্যে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক এবং ওয়াকফ পরিদর্শকের নামও অন্তর্ভুক্ত করেছেন আ. হান্নান।এজাহারে বাদী বলেন, সরকারিভাবে আসা উন্নয়ন বরাদ্দ, ইমাম মুয়াজ্জিনদের আবাসন সংস্কার, মসজিদের মাঠ-জমি-মার্কেটের ভাড়া, পুকুরের মাছ বিক্রি, দান-বাক্সে জমা এবং মসজিদের নামে থাকা কৃষি জমি বন্দোবস্ত, মসজিদের পুরাতন ঘর, ইমাম-মুয়াজ্জিন খাদেমের পুরোনো আবাসন, পুরোনো পাঠাগার ভবন এবং মসজিদের জমিতে থাকা মার্কেটের পুরাতন ভবন বিক্রি বাবদ মোট ৯০ লাখ টাকা মসজিদের কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন মাহবুব এবং রাকিবুল। নিজেদের প্রয়োজনে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এই বড় জামে মসজিদের ৩.৫৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণ বাবদ সরকারিভাবে দেওয়া টাকাও মসজিদের ফান্ডে জমা হয়নি। মাহবুব এবং রাকিবুল মসজিদের দায়িত্বে থাকার সময়েই ওই জমি অধিগ্রহণ করে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।মসজিদের পুরো সম্পত্তিই যেখানে ওয়াকফ এস্টেটভুক্ত সেখানে ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া এর কোনো সম্পদ বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের সুযোগ নেই। কিন্তু এই দুজন মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে কোনোরকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে মসজিদের মালিকানায় থাকা প্রায় আড়াই একর জমি বিক্রি করেছেন। এরমধ্যে ১ একর ১২ শতাংশ জমি নিয়েছেন নিজেদের নামে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব ৬৯ শতাংশ, সাবেক মেয়র বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান রাকিবুল এবং তার স্ত্রী সুরাইয়া নাসরিন ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ইউসুফ আলী ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি এভাবে দলিল করে নিয়েছেন। এছাড়া আরও ১ দশমিক ৪৫৯০ একর জমি বিক্রি করা হয়েছে বিভিন্ন লোকজনের কাছে। আলোচ্য এই প্রায় আড়াই একর জমি কেনাবেচায়ও করা হয়েছে দুর্নীতি।

বাজার দর হিসাব করলে এই পরিমাণ জমির মূল্য দাঁড়ায় কম করে হলেও ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু কেনাবেচা প্রশ্নে মৌজা দর উল্লেখ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে ১৫ কোটি টাকারও বেশি। আবার জমি বিক্রির এই টাকা মসজিদ নির্মাণসহ কৃষি জমি ক্রয় বাবদ খরচও দেখিয়েছে তারা। অথচ এসবের কোনো বৈধ কাগজপত্র মসজিদের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে কিংবা ফাইলে নেই।মামলার বিষয়ে বাদী আ. হান্নান বলেন, খেপুপাড়া বড় জামে মসজিদের এই জমিসহ সব সম্পত্তি ওয়াকফ এস্টেটের অধীন। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া এখানে কিছু করা সম্পূর্ণ বেআইনি। এই যে আড়াই একর জমি হাতবদল হয়েছে এর কোনোরকম কোনো বৈধতা নেই। এসব জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে মৌজা দরে টাকা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মসজিদের জমি যে মৌজায় রয়েছে তার সরকারি দর বিক্রিকালীন সময়ে ১-২ লাখ টাকার বেশি ছিল না। যদিও তখন বাজার দর ছিল এর ৮-১০ গুণ বেশি।মাহবুব, রাকিবুল এবং ইউসুফ আলী যেসব জমি নিয়েছে তার পুরোটাই ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে কলাপাড়া ব্রিজের আশপাশে। ওই জমি যে এখন কতটা মূল্যবান তা শুধু এই অঞ্চলের মানুষই জানেন। সম্পূর্ণ অবৈধ প্রক্রিয়ায় মালিকানা বদল হওয়া এসব জমি বিক্রির বিপুল টাকা জমা হয়নি মসজিদের নামে থাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। শুধু কাগজে-কলমে বিক্রি আর খরচ দেখানো হয়েছে। অথচ নিয়মানুযায়ী টাকা ব্যাংকে যাওয়ার কথা। তারপর কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খরচ হবে।অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাকিবুল আহসান বলেন, ‘মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কমিটির সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব কাজকর্ম হয়েছে। সভাপতির অনুমোদনের বাইরে কিছুই হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করানোর জন্য আ. হান্নানকে ব্যবহার করে এই মিথ্যা মামলা করিয়েছে। তাছাড়া ১৪ বছর আগের বিষয় নিয়ে এখন মামলা করা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পটুয়াখালী-৪ আসনের সাবেক এমপি এবং সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান বলেন,মসজিদের এসব বিষয়ে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাছাড়া মসজিদের কাজে কোনোরকম দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠে না। আমি আইনগতভাবে এর মোকাবিলা করব।’ মসজিদের জমি নিজের মালিকানায় নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে অবশ্য তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Top