আন্দোলন করেন, মিছিল-মিটিং করেন, আপত্তি নেই
মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া : বিএনপি-জামায়াতের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্দোলন করেন, মিছিল-মিটিং করেন, আপত্তি নেই। কিন্তু আন্দোলনের নামে অতীতের মতো অগ্নিসন্ত্রাস করলে, পুড়িয়ে মানুষ মারতে চাইলে, কারও ওপর আক্রমণ হলে, একটাকেও ছাড়ব না। আমাদের ওপর হামলা হয়েছে সহ্য করেছি, তবে মানুষের ওপর হামলা হলে সহ্য করব না। আমরা সহ্য করছি, তবে এটাকে অনেকে দুর্বলতা মনে করছে। কিন্তু এটা আমাদের দুর্বলতা নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে, আমাদের সঙ্গে আছে। খুনিদের সঙ্গে নেই।শনিবার বিকালে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ জাতীয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আন্দোলন করতে গিয়ে নারী নেত্রীদের ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতন ও হামলার শিকার হওয়ার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা তো কিছু করছি না। তাদের (বিএনপি) মেয়েরা ইচ্ছামতো মিছিল করছে, আন্দোলন করছে, স্লোগান দিচ্ছে, আমরা বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু তারা যেভাবে অত্যাচার করেছিল আমরা ভুলব কীভাবে? সাধারণ মানুষ ভুলবে কী করে? তারপর তাদের অগ্নিসন্ত্রাস, এটা কোনো মানুষের কাজ? জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরে ফেলা নাকি তাদের আন্দোলন!মানবাধিকারের কথা বলে হত্যাকারীদের সঙ্গে সংলাপের আহ্বান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আজ অনেকে বলেন ডায়ালগ করতে হবে। কাদের সঙ্গে ডায়ালগ (সংলাপ)? বিএনপির খালেদা জিয়া, তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত আসামি। যারা গ্রেনেড হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। যে খালেদা জিয়া বলেছিলেন-শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারবেন না। আর আওয়ামী লীগ ১০০ বছরেও ক্ষমতায় যাবে না। তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা এ ধরনের গর্ব করা কথা পছন্দ করেন না। আর বাংলাদেশের মানুষ তো একেবারেই পছন্দ করে না। সেজন্য খালেদা জিয়ার মুখের কথা তার নিজের ক্ষেত্রেই লেগে গেছে। এখন ওই দুর্নীতিবাজ, সাজাপ্রাপ্ত, এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, অর্থ পাচারকারী, অস্ত্র পাচারকারী আর গ্রেনেড হামলাকারী, আইভী রহমানের হত্যাকারী-এদের সঙ্গে ডায়ালগ করতে হবে? আলোচনা করতে হবে? যারা এ ধরনের প্রস্তাব দেয় তারা আবার মানবাধিকারের কথাও বলে। এটা কেমন ধরনের কথা? সেটাই আমি জিজ্ঞেস করি।
নির্বাচন করার মতো শক্তি না থাকলে তারা হয়তো নির্বাচন করবে না : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে। নির্বাচন কমিশন আছে। তাই যাদের ইচ্ছা আছে তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর নির্বাচন করার মতো শক্তি যদি কারও না থাকে, তারা হয়তো নির্বাচন করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন করবে, তারা ভোট দেবে। আর ভোট চুরি করলে দেশের জনগণ মেনে নেয় না। খালেদা জিয়া ভোট চুরি করেছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে। বাংলাদেশের মানুষ তাকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছিল কিন্তু দেড় মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ৩০ মার্চ জনগণের আন্দোলনে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ভোট চুরির অপরাধে। তাই ভোট চোররা ভোট চুরি করতেই জানে। তাই আমি আমাদের মেয়েদের বলব-ভোটের অধিকার সবার। যে কোনো নির্বাচনে আমাদের মহিলারা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেবে। গণতান্ত্রিক অধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে।
একমাত্র আ.লীগই ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়ন করে : শেখ হাসিনা বলেন, একমাত্র আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়ন করে, মানুষের কল্যাণে কাজ করে। কিন্তু বিএনপি কী করে? তারা (বিএনপি) ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে কত মেয়েকে নির্যাতন করেছে? বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা নেই তারা অত্যাচার করেনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে নির্যাতন করেছিল, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে ঠিক একইভাবে অত্যাচার করেছিল।
নারী-পুরুষকে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোনো অর্জনে নারীদের অবদান থাকতে হবে। সমাজের অর্ধেক নারী। তারা অচল থাকলে সমাজ এগিয়ে যাবে না। নারী-পুরুষকে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে। আমি নারীদের বিচারপতি, সচিব, ডিসি, এসপি হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পথ সুগম করি। আজকে আমাদের মেয়েরা প্রতিটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তিনি বলেন, যে কোনো অর্জনে নারীদের অবদান থাকতে হবে।
ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে : সন্তানদের বিপথে যাওয়া ঠেকাতে মায়ের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন-মায়েদের বলব, তাদের সন্তান যেন জঙ্গিবাদ, মাদক বা সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়। প্রত্যেক মা-কে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। তারা যেন নিজের মনের কথা মায়ের কাছে খোলা মনে বলতে পারে-সে ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাহলে ছেলেমেয়ে কখনো বিপথে যাবে না। তাদের খবর রাখতে হবে। কী করছে, কোথায় যাচ্ছে-সেদিকে নজর রাখতে হবে।
ইসলাম ধর্ম নারীদের সমান অধিকার দিয়েছে : সরকারপ্রধান বলেন, যারা মেয়েদের অধিকার নিয়ে কথা বলে, আর পর্দার আড়ালে রেখে দিতে চায়, তাদের বলব, কে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন? কোনো পুরুষ সাহস করে এগিয়ে আসেননি। একজন নারী এসেছিলেন। তিনি হচ্ছেন বিবি খাদিজা। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্মই একমাত্র ধর্ম, যেখানে নারীদের সমান অধিকার দিয়েছে। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ি, দুদিকে সম্পদের অধিকার দিয়েছে একমাত্র ইসলাম ধর্ম। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার কথা উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আমরা যে ঘর ও জমি দিচ্ছি সেখানে কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনের সমান অধিকার। আরেকটা কথাও আছে, নতুন ঘর পেয়ে কেউ যেন নতুন বউ আনতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করেছি। যদি কোনো দ্বন্দ্ব হয়, কেউ যদি বিয়ে করতে চান, তাহলে সেই স্বামীর ওই বাড়িতে কোনো অধিকার থাকবে না। তখন ওই নারীর একার অধিকার হবে।
গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে : প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগই এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আমরা পরপর তিনবার ক্ষমতায় এসেছি জনগণের ভোটে। আজ গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে, পুরো বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে তুলব। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই।বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ি সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফিয়া খাতুন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন বিদায়ি সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম। সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন-আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক রোজিনা নাসরিন। সাংগঠনিক রিপোর্ট উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম। এ সময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ বাঁচাতে হলে আ.লীগকে বাঁচাতে হবে-ওবায়দুল কাদের : সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দেশের উন্নয়ন ও অর্জন বাঁচাতে শেখ হাসিনা সরকারের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, বিএনপির এ কথা, সে কথা যাই বলুক, তাদের মূল লক্ষ্য এখনো শেখ হাসিনা। তাকে হটানোই তাদের মূল লক্ষ্য। আওয়ামী লীগের চেয়েও তাদের বড় লক্ষ্য শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে তারা নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। এতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা আওয়ামী লীগ স্বীকার করে বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার শিকার আমরা। নেত্রী এটা স্বীকার করেন। এজন্য তার ঘুম নেই, নির্ঘুম রাত কাটান। আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনি (শেখ হাসিনা) কয় ঘণ্টা ঘুমান? তিনি জানিয়েছেন, ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। দেশের জন্য, মানুষকে বাঁচাতে, তাদের কষ্ট সামাল দিতে তিনি দিবারাত্রি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এ সময় শেখ হাসিনা নারীদের গর্ব বলে জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আছেন বলেই বাবার সঙ্গে মায়ের নাম সন্তানের পরিচয়পত্রে যুক্ত হয়েছে।
বর্ণিল সাজে নেতাকর্মীরা : মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঘিরে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। বেলা ৩টায় এ সম্মেলন শুরুর কথা থাকলেও সকাল থেকেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে নেতাকর্মীদের ঢল নামে। ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা সম্মেলনে যোগ দেন। বাদ্য-বাজনার তালে তালে, জয় বাংলা স্লোগানে গোটা সোহরাওয়ার্দী এলাকা প্রকম্পিত করে, দল বেঁধে একই রঙের শাড়ি পরে নেতাকর্মীরা সম্মেলনে যোগ দেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনস্থলে প্রবেশের জন্য একাধিক গেট রাখা হয়। প্রবেশপথগুলোতে লাইনে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীদের প্রবেশ করতে দেখা যায়। দুপুর সোয়া ২টায় কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা। বেলা পৌনে ৩টায় প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনস্থলে পৌঁছানোর আগেই বিশাল প্যান্ডেল ছাপিয়ে যায়। আশপাশের সব জায়গায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনস্থলে এসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। শুরুতেই সাফিয়া খাতুন এবং মাহমুদা বেগম প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে এবং উত্তরীয় পরিয়ে স্বাগত জানান। মহিলা আওয়ামী লীগের উত্তর ও দক্ষিণের নেত্রীরা প্রধানমন্ত্রীকে ক্রেস্ট উপহার দেন। মহিলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক পর্বে ‘রক্ত লাল’ ‘তুমি হৃদয়ের ধ্রুবতারা’ ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’ ‘জাগো নারী জাগো’সহ মহিলা আওয়ামী লীগের দলীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর গীতিনৃত্য এবং সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পীরা।