সরকারের আর্থিক বিধিবিধানসংক্রান্ত অনুমোদিত বই সহায়ক হিসাবে পরীক্ষার হলে নেওয়া যাবে - Alokitobarta
আজ : শুক্রবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সরকারের আর্থিক বিধিবিধানসংক্রান্ত অনুমোদিত বই সহায়ক হিসাবে পরীক্ষার হলে নেওয়া যাবে


মোহাম্মাদ আবুবকর সিদ্দীক ভুঁইয়া :সরকারের আর্থিক বিধিবিধানসংক্রান্ত অনুমোদিত বই সহায়ক হিসাবে পরীক্ষার হলে নেওয়া যাবে। কিন্তু এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রীতিমতো নকলের মহোৎসব করছেন একশ্রেণির নীতিহীন ক্যাডার কর্মকর্তারা। যারা পরীক্ষার হলে নিয়ে যাচ্ছেন অনুমোদিত বইয়ের নামে ‘নকলপত্র’। বইয়ের ভিতরে গাইড বইয়ের চরিত্র। সেখানে থাকছে একেবারে উত্তরপত্রের বিস্তারিত বর্ণনা। এভাবে বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে একটি চক্র দীর্ঘদিন থেকে বই প্রকাশ করে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছে। নেপথ্যে জড়িত প্রভাবশালী অনেকে। চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে।প্রসঙ্গত, চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের চাকরিতে প্রবেশের দুই বছরের মধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। যার নাম চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত বিভাগীয় পরীক্ষা। অবশ্য এর আগে এই পরীক্ষার পূর্বশর্ত হিসাবে দুই মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ এবং চার মাস মেয়াদি বুনিয়াদি কোর্স করে উত্তীর্ণ হতে হয়। তিনটি বিষয়ে পিএসসির এই পরীক্ষার দ্বিতীয়পত্রের নাম নিরীক্ষা ও হিসাব। এই পত্রে সরকারি চাকরির যাবতীয় বিধানাবলি এবং সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি সম্পর্কে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে হয়। তবে পরীক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এ সংক্রান্ত সরকারি বিভিন্ন গেজেট ও প্রজ্ঞাপন সম্পর্কে ধারণা পেতে সরকার অনুমোদিত এ সংক্রান্ত বই পরীক্ষার হলে সঙ্গে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়।তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, মূলত এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তারা অনুমোদিত বইয়ের মোড়ক ব্যবহার করে রীতিমতো পুরো ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিচ্ছেন নোট বই দেখে। চাকরির বিধানাবলি সংক্রান্ত বাজারে যে কটি বই আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বহুল পরিচিত বই লিখেছেন সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া। এছাড়া ফিরোজ মিয়ার এই বইটিই সরকার অনুমোদিত। অর্থাৎ পরীক্ষার্থীরা সহায়ক হিসাবে চাকরির বিধানাবলি সংক্রান্ত তার লেখা বই পরীক্ষার হলে নিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে এই বই নিয়ে ঘটেছে ভয়াবহ এক জালিয়াতি।

বুধবার রাজধানীর নীলক্ষেত থেকে এ ধরনের একটি বই কিনে দেখা গেছে, বইয়ের মোড়কের সঙ্গে ভেতরের কনটেন্ট বা লেখার মধ্যে কোনো মিল নেই। আদি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির মোড়ক ওল্টালে দেখা যাবে ভেতরে লেখা আছে, ‘প্রশাসন, পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিসহ সব ক্যাডারের বিভাগীয় পরীক্ষার নিরীক্ষা ও হিসাব দ্বিতীয়পত্রের সহায়িকা’। এখানে আবার লেখক হিসাবে নাম লেখা আছে সাবেক অতিরিক্ত সচিব আমিনুল বর চৌধুরী এবং সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান মো. এমদাদুল হকের। কিন্তু বইয়ের ভেতরে রয়েছে পুরো উত্তরপত্রে ঠাসা।এদিকে এ বিষয়ে চাকরির বিধানাবলি বইয়ের লেখক ফিরোজ মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমিও শুনেছি। এটা তো বড় ধরনের জালিয়াতি। এদের বিরুদ্ধে তিনি এখন কী করবেন, তাই ভাবছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা তো খুবই দুঃখজনক। চাকরি জীবনের শুরুতে যদি এ ধরনের জালিয়াতি ও নকলের আশ্রয় নিয়ে চাকরি স্থায়ী করা হয়, তাহলে এসব কর্মকর্তাদের কাছে ভবিষ্যতে জাতি ভালো কিছু আশা করতে পারবে না। এরা তো এক সময় সচিবের মতো শীর্ষ পদেও যাবেন।মোড়ক জালিয়াতি করে বইটি প্রকাশ করেছে আদি প্রকাশনী। তাদের রয়েছে সুমন ল’বুক সিন্ডিকেট। আদি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জাহিদুল হোসেন সুমন বলেন, ‘এটা তো অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। এভাবে ফিরোজ মিয়া স্যারের বইয়ের মলাট না দিলে তো উনারা পরীক্ষার হলে নিতে পারবেন না। কারণ সরকারি অনুমোদন রয়েছে উনার বইয়ের। তাই এভাবে গাইড বই প্রকাশ করা হচ্ছে।’ কেন এ ধরনের ভয়াবহ প্রতারণা ও জালিয়াতি করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একা নয়। অনেকেই করছে। এই বইয়ের তো অনেক চাহিদা। যারা পরীক্ষা দেন তারা কিনে নেন।’ কিচ্ছুক্ষণ পর তিনি কলব্যাক করে জানতে চান, ‘কোনো সমস্যা হবে নাকি? সমস্যা হলে কিংবা পুলিশ এলে একটু বলে দিয়েন ভাই।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব এবং বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে সহায়ক হিসাবে পরীক্ষার হলে অনুমোদিত বই নেওয়ার বিধান আছে। তবে এভাবে জালিয়াতি করে উত্তরপত্র ও নোটবই নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘চাকরি স্থায়ীকরণসংক্রান্ত পরীক্ষায় অনেক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এজন্য পাশের হারও অনেক কমে গেছে। আগে ৭০-৮০% পাশ করলেও সর্বশেষ পরীক্ষায় পাশের হার ছিল ৬৬%। তবে অভিযোগটি আমরা গুরুত্বসহকারে নিচ্ছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিএসসি’র একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা অনেক আগে থেকে ঘটে আসছে। তবে এখন অনেক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। গত পরীক্ষার সময় মলাট জালিয়াতি করা অনেকগুলো বই জব্দ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বইয়ের ভেতরের কনটেইন যাচাই না করে কাউকে বই নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না।সূত্র জানায়, আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ক্যাডারের এই বিভাগীয় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য কয়েকদিন থেকে নিরীক্ষা ও হিসাব বিষয়ে দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার সহায়ক বইটি (৭১৪ পৃষ্ঠার) এখন চাকরির বিধানাবলির মলাটে দেদার বিক্রি হচ্ছে। যদিও আদৌতে এটি কোনো বই নয়। মূল বইয়ের মোড়ক বা মলাট নকল করে আস্ত একটা নকলপত্র প্রকাশ করা হয়েছে।এ বিষয়ে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘এদের কারণে কোথাও আমরা মূল্যায়ন পাচ্ছি না। সময়মতো পদোন্নতি না হওয়া ছাড়াও সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের অনেককে পদে পদে নিগৃহীত হতে হয়। কিন্তু যারা এভাবে নকল করে পাশ করছেন, তারা চলে আসছেন নেতৃত্বে। প্রাইজপোস্টিংসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি তাদের জন্য যেন অপেক্ষায় থাকে। এ বাস্তবতা শুধু এই সরকারের আমলের চিত্র নয়, এটিই হয়ে আসছে।

Top